কর্মীদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য; সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদবী

শৈল্পিক মেহনত কার্যকর নয়
ইসলামের ইতিহাস সামান্য অধ্যায়নের সুযোগ এ অধমের হয়েছে। নতুন করে ইসলামী জাগরণে মুসলমানদের পারস্পরিক সৌহার্দ ও হৃদ্যতা বিষয়ে আজ আমাকে কিছু বলতে বলা হয়েছে। নির্ধারিত বিষয়ে ইতিহাস অধ্যায়নের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা থেকে আলোচনা করতে প্রয়াসী হব।
সুধীমণ্ডলী! আমি বিশ্বাস করি, কর্মীদের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক ও হৃদ্যতা ভিন্ন কোন কারণে হয় না। আমার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জ্ঞানে এমন কোন উপাদান খুঁজে পাচ্ছি না, যা আটার খামিরার মত মানুষের হৃদয়পটে অঙ্কিত করে দেয়া যায়। তবে একথা অনস্বীকার্য, শিল্পগত মেহনত মানবের পারস্পরিক হৃদ্যতা বজায় রাখতে যুৎসই হাতিয়ার নয়। ভালবাসা-সম্প্রীতির গতিধারার সূতিকাগার হচ্ছে আত্মা, যা উপলব্ধি করতে হয়। দলিল-দস্তাবেজ দিয়ে বোঝানো অসম্ভব। জগতে এমন কোন মাধ্যম খুঁজে পাওয়া যাবে না, যা আকর্ষণহীন ভাঙ্গা হৃদয়ে অনুরাগ সৃষ্টি করতে পারে। তেমনিভাবে যাদের মাঝে নেই কোন বাস্তবতা, না আছে অনুভূতির আধিক্য। তাদের মাঝে সেতুবন্ধন রচনা করার মত কোন মাধ্যম খুঁজে পাওয়া গেছে বলে আমার জানা নেই। কাগজের এক পৃষ্ঠাকে অপর পৃষ্ঠা দ্বারা ঢেকে দেয়া যায় কিন্তু মানবের আত্মগত ব্যাপারটি ভিন্ন রকমের, স্বতন্ত্র ধাঁচের। এটি একটি অত্যন্ত নাযুক ব্যাপার, সুকঠিন প্রয়াস। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, দুনিয়ার যাবতীয় সম্পদ ব্যয় করলেও তুমি তাদের মাঝে প্রীতি স্থাপন করতে পারতে না।( সুরা আনফাল:৬৩)
তোমাদের কাছে যত ধন ভাণ্ডার আছে তার, তার সবটুকু ব্যয় করলেও তাদের মনে প্রীতির সঞ্চার করতে পারবে না। আল্লাহ তা’আলা ঐক্যের সূত্রে তাদেরকে গ্রথিত না করলে, মনে প্রীতির সঞ্চার না করলে, জাগতিক কোন শক্তি তাদের মনে সৌহার্দের ভিত্তি স্থাপন করতে পারত না।
ভ্রাতৃত্বের অপূর্ব মিলন
আপনারা জানেন মক্কা মুকাররম থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় যখন হিজরত শুরু হয়, তখন মুহাজির আনসারদের মাঝে মানবতা বা মনুষ্যত্ববোধ আর আরবি ভাষা ছাড়া আর কোন সম্পর্ক ছিল না। দীর্ঘ আলোচনার দিকে না গিয়ে শুধু এতটুকু বলতে চাই, আনসারদের বংশ আর মুহাজিরদের বংশীয় সম্পর্ক ছিল হেজাযের আদনান গোত্রের সাথে, এতদসত্ত্বেও তাদের মাঝে একটা ঐক্যের সূচনা হয়েছিল।আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
আর তোমরা সে নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যা আল্লাহ তোমাদেরকে দান করেছেন। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন। (সুরা আলে ইমরান: ১০৩)
উদাহরণ
উপরিউক্ত ব্যাপারে এখন দু’একটি উদাহরণ পেশ করছি। অতঃপর মূল আলোচনায় ফিরে যাব। প্রথম উদাহরণটি সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দিচ্ছি। এর চেয়ে অতি উত্তম উদাহরণ আর হতে পারে না।
উহুদের যুদ্ধে মক্কায় মুশরিকদের কিছু লোক গ্রেফতার হয়েছিল। তন্মধ্যে আবু আজীজ বিন উমায়ের নামক এক ব্যক্তি ছিল। তার আপন ভাই মুছআব ইবনে উমায়ের রা. বদরের একজন ঝান্ডাবাহী সৈনিক ছিলেন। তিনি প্রথমেই মদীনায় এসেছিলেন। আবু আজীজ বিন উমায়ের এর মশক যখন বাঁধা হচ্ছিল তখন মুসআব রা. গ্রেফতারকারীকে লক্ষ করে বললেন, খুবই শক্ত করে বাঁধ। এর দ্বারা অনেক টাকা পয়সা উসূল হবে।আবু আজিজ: ভাই সাহেব! আমি মনে করেছিলাম, আমার ব্যাপারে আপনি কোন ভাল কথা বলবেন, আমার জন্য সুপারিশ করবেন যে, এ আমার ভাই! একটু খেয়াল করে তাকে বাঁধন দিও। ঢিলেঢালা করে বাঁধ। হায়রে আমার মায়ের উদরের সন্তান, পাপের কলিজার টুকরা! আপনি উল্টা সিধা বলা শুরু করেছেন, বলছেন আরো শক্ত করে বাঁধতে, যাতে মুক্তিপন বেশি আদায় করা যায়।
তখন হযরত মুছআব রা. উত্তর দিয়েছিলেন, যা ইতিহাসে উজ্জল হয়ে থাকবে। তিনি বলেছিলেন, তুমি আমার ভাই নও। আমার ভাই তো সে, যে তোমায় শক্ত করে বাঁধবে।
একত্ববাদের বিশ্বাস ও নিঃস্বার্থ ভালবাসা
মুছআব রা. এর মনে একত্ববাদের বিশ্বাস ও নিঃস্বার্থ ভালবাসা এমন বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল যে, তিনি আপন ভাইয়ের দরদ ও স্বার্থ ভুলে গিয়ে ব”লছিলেন এখন তুমি আমার ভাই নও। আমার ভাই ঐ ব্যক্তি যে তোমার বাহু মক্ত কওে বাঁধবে। তিনি এক নতুন আত্মীয়তার জন্ম দিলেন। সেটা রক্তের সম্পর্কের চেয়েও এক বিশাল মুবারক, উপকারি ও নন্দিত সম্পর্ক।
একত্ববাদ মানুষকে নিঃস্বার্থ ভালবাসা শেখায়। নিখাদ ভালবাসা, মায়া-মমতা মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করলে মানুষকে করে তোলে এক অনন্য গুণের অধিকারী। নিঃস্বার্থ ভালবাসা ও সম্প্রীতি যে জাতির মধ্যে প্রতিফলিত, ঐ জাতির উন্নতি কে ঠেকায়? তারা এমনও উপমা পেশ করেন, যা ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
ইসলাম আমাদের এক পরম সম্পদ, ইসলামের কথায় কুরআন সিরাত পরিপূর্ণ, আত্মসঞ্জীবনী ও বিপ্লবাত্মক এই দ্বীন ও তার অলৌকিক ক্ষমতা সত্যিই এক অন্য শক্তি আমরা যা নিয়ে গৌরববোধ করতে পারি। আমাদের কাছে শক্তির যে প্রস্রবণ রয়েছে, তা আমাদের আত্মাকে কাবু করতে পারে, দূর হয় কু-প্রবৃত্তি এবং যদ্দারা দল ও অন্তর পরিষ্কার হয়, জমিনের অন্ধকার দূর করে আমরা আলোকজ্জ্বল রাজপথে পৌঁছতে পারি, তাগুতের বিরূদ্ধে সীসা ঢালা প্রাচিরের ন্যায় রুখে দাড়াতে পারি, সেই শক্তির উৎস হচ্ছে আল্লাহর কিতাব তথা আল কুরআন। কুরআন মাজিদ আজও আপন শক্তিতে উজ্জ্বল, উপচে পড়ছে তার সঞ্জীবনী শক্তি। আমি আরজ করতে চাই, সর্বপ্রথম যে জিনিসের সাথে আমাদের মহাব্বত রাখতে হবে, তা হল সীরাতে নবী। আজও তা নয়া বিপ্লবের জোয়ার বইয়ে দিতে পারে। সীরাতুন্নবী পর্যালোচনা করুন আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হবে এক অধ্যায়। সমাজ জীবনের আমরা যেখানেই সীরাতকে বিদায় দিয়েছি, সেখান থেকেই আমাদের পতন শুরু হয়েছে। তাই সীরাতকে আঁকড়ে ধরতে হবে আমাদের হৃত ঐতিহ্য পুনরূদ্ধার করতে হবে।
কু-প্রবৃত্তি একটি ব্যাধি
তারিখে ইসলামের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হচ্ছে কু-প্রবৃত্তির পূজা। শত্রুর শত্রুতা আমাদের কখনো পরাজিত করতে পারিনি। আমাদের পরাজয় ত্বরান্বিত করেছে আত্মকলহ। অহেতুক মত পার্থক্যের কারণে আমাদের সেই আজিমুশ্বান সালতানাত হাতছাড়া হয়েছে, ফকির হয়েছি আমরা। এক্ষেত্রে আমি একটি উদাহরণ পেশ করছি। স্পেন থেকে মুসলিম জাতির নাম নিশানা মুছে গেছে একমাত্র গৃহযুদ্ধ ও আত্মকলহের কারণে। এ কথা আমি কস্মিনকালেও বিশ্বাস করি না শুধু খৃষ্টান ক্রুসেডাররা আমাদেরকে স্পেন থেকে বিতাড়িত করেছে। মুসলিম শক্তির প্রদিপটির তেল শেষ হওয়ার মূলে দায়ী ছিল উত্তর আরবীয়, হেজাযীয়, ইয়ামানী আরবদের গৃহযুদ্ধ ও অহেতুক আত্মকলহ ও মতপার্থক্য। ইকবালের ভাষায়, স্পেনের বড় বড় মসজিদ দেখা গেছে অনেক দিন, কিন্তু চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আজান দেয়ার কন্ঠ। মুসলিম বিতাড়িত প্রতিটি রাষ্ট্রেরই উপাখ্যান একই ধরনের, বিশেষ করে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মোগল সম্রাটদের।
ইসলামী চেতনাকে জীবনের লক্ষ্য বানাও
আত্মার রোগ শুধু নসিহত বা প্রবন্ধ পাঠের মাধ্যমে উপশম করা যাবে না। কোন বস্তুকে পরাজিত করতে হলে তার বিপরীত বস্তুকে তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হতে হয়। যেমন আগুন নেভাতে হলে পানি ঢালতে হয়। কোন জিনিসকে গরম করতে হলে আগুনের দরকার হয়। আত্মার চেয়ে নসিহত ও প্রবন্ধ শক্তিশালী নয়, তাই তা দ্বারা আত্মার রোগ নিবারণ করা সম্ভব নয়। ঐ রোগ শরীরে থাকাকালীন আমাদের পারস্পরিক মহাব্বত ও সুসম্পর্ক বজায় থাকবে না। সর্ববিধ চেতনার ওপর ইসলামকে প্রাধান্য না দিলে পরিস্থিতি বদলাবে না বরং পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।
জড়বাদ নয় রাসুলের আদর্শই মুক্তির পথ
আমি ইউরোপের বিভিন্ন সফরে প্রায়শই বলে আসছি, আজ আপনাদের সামনে এক বিরাট পরীক্ষা! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাদের আঁচল ধরে থাকবেন, তিনি আল্লাহর কাছে কিয়ামত দিবসে এই মামলা করবেন, আমি তোমাদেরকে এক বিশাল ময়দানে রেখে এসেছিলাম, তোমরা এখানেই ইসলামের আলো ছড়াতে পারতে, দিগি¦জয়ীদেরকে বিজিত করতে পারতে, কিন্তু তোমরা আত্মকলহ, গৃহযুদ্ধ ক্ষমতা দখলের রেষারেষিতে লিপ্ত ছিলে। বল! তোমরা সেদিন কী জবাব দেবে?

শেয়ার করুন

আরো পড়ুন

যোগদিন আমাদের সাথে

ইসলামের মূল তিন কাজ- তা’লীমে দ্বীন (দ্বীনের শিক্ষা), তাবলীগে দ্বীন (দ্বীনের দাওয়াত) ও তাগলীবে দ্বীন (দ্বীনের বিজয়) এর সমন্বয়ে ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য পাঁচ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ১. দাওয়াত, ২. সংগঠন, ৩. প্রশিক্ষণ, ৪. সমাজকল্যাণ, ৫. আন্দোলন। আমি বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস ঘোষিত কর্মসূচির সাথে একাত্মতা পোষণ করছি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এ সংগঠনে যোগদান করছি।

Scroll to Top