ঈমানের পরিচয়ঃ মাওলানা শহীদুল ইসলাম

কোন ব্যক্তি নিজেকে মুমিন হিসাবে মৌখিক দাবি করার নাম ঈমান নয়। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- মানুষের মধ্যে কেউ কেউ এমন রয়েছে যারা বলে আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ তায়ালা ও কিয়ামত দিবসের ওপর অথচ তারা মুমিন নয়। তারা আল্লাহ ও মুমিনদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে। প্রকৃত অর্থে তারা নিজেরা নিজেদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে কিন্তু তারা উপলব্ধি করতে পারছে না। (বাকারা-৮, ৯) আবার দ্বীনের সত্যতা উপলব্ধিতে থাকার নামও ঈমান নয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন- তারা জুলুম ও অহঙ্কার বশত (ঈমান) অস্বীকার করলো উক্ত বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরও। আপনি দেখেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পরিণাম ফল কেমন হয়েছিল। ( নাহল:১৪) তাহলে ঈমান কাকে বলে? ঈমানের পরিচয় কি? যদি আমরা ঈমানকে আল্লাহর ভাষায় বুঝতে চাই, তাহলে নিন্মোক্ত আয়াতটি পড়তে পারি। আল্লাহ বলেন- পূণ্য কেবল এই নয় যে, তোমরা নিজেদের মুখ পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে, বরং প্রকৃত পূণ্যবান তো সে, যে ঈমান রাখে আল্লাহ, কিয়ামত দিবস, সকল ফেরেস্তা, আল্লাহর কিতাব ও নবীদের ওপর। (বাকারা-১৭৭) একথাটা আরো পষ্ট হয়ে উঠেছে হাদীসের পাতায়। ঘটনাটা এভাবে এসেছে হাদীসবেত্তাদের কলমেÑ একদিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের সামনে আসলেন। তখন এক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞাসা করলেন হে আল্লাহর রাসল! ঈমান কি? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন ঈমান হলো আল্লাহ তায়ালা, তার ফেরেস্তা, কিতাব এবং তার সাক্ষাত লাভ ও তার রাসুলগণের প্রতি বিশ্বাস এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার সাথে সাথে তাকদিরের ওপরও বিশ্বাস স্থাপন করার নাম। (ইবনে মাজাহ)
উল্লিখিত আয়াত ও হাদিসের আলোকে বলা যায়- এক আল্লাহ, তাঁর কিতাব, ফেরেস্তা, নবীগণ, কিয়ামত দিবস ও কিয়ামত দিবসে আল্লাহর সাক্ষাতে সাথে সাথে তাকদিরের ওপরও বিশ্বাস স্থাপনের নাম হল ঈমান।
ঈমানের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ
শাব্দিক অর্থে ঈমান বলা হয়- কোন কিছু মেনে নেওয়া, বিশ্বাস করা, স্বীকৃতির সাথে সাথে আমলে আনাকে। আর ঈমানের পারিভাষিক পরিচয় আকাবির আসলাফগণ বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। তবে সকলের বক্তব্যের মূল বিষয় এক। নিম্নে ঈমানের পারিভাষিক পরিচয় তুলে ধরা হল- হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমানতদারী ও দিয়ানতদারী ওপর আস্থা ও বিশ্বাস থাকায় তার থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত সকল কথা ও কাজকে মেনে নেওয়ার নাম হল ঈমান। (ফয়জুল বারী) আমরা একথার সমর্থন পাই সুরা হাশরের সাত নং আয়াত থেকেও। এর পক্ষে কাশফুল বারীর ভাষ্য বড়ই চমৎকারÑ হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমানত ও দিয়ানত রক্ষা করে যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন সে দ্বীন কে সত্য মানা” এখানে এই শর্ত দ্বারা বুঝা যায়, কোন ব্যক্তি যদি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি আস্থা না রেখে বা রাখতে না পারার কারণে আকল জ্ঞান বিজ্ঞান যুক্তি তর্কের বিভিন্ন সূত্র দ্বারা শরীয়তকে মেপে তার ভিত্তিতে দ্বীন মানা আর না মানা শুরু করে তাহলে সে কখনো মুমিন হতে পারবে না। (কাশফুল বারী শরহুল বুখারি- খ:১, পৃ: ৪৪৬)
বর্তমান যুগ হল যুক্তিতর্ক জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগ। সবকিছুতেই টেনে আনা হয় যুক্তি কিংবা বৈজ্ঞানিক দর্শন। বৈজ্ঞানিক থিওরি ছাড়া সবই যেন বিকল। এরই ধারাবাহিকতায় দ্বীন ও ঈমান বিষয়েও আধুনিক দর্শন, যুক্তিমুক্তি তর্কবিতর্ক ও বৈজ্ঞানিক থিওরি দিয়ে যাচাই বাছাই চলছে। যুক্তিমুক্তি তর্কবিতর্ক ও জ্ঞানবিজ্ঞানকে ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, সংস্কৃতি-অপসংস্কৃতি, সংস্কার কুসংস্কার, অধিকার-অনাধিকার এবং ধর্ম-অধর্মকে মাপার মানদণ্ড বানিয়েছে। আফসোসের সুরে বলতে হয়- দ্বীনের মতো মহান কাজকেও বিজ্ঞান সন্দেহের চোখে দেখে। দ্বীনের অনেক প্রমাণিত বিষয়কে অনেকে মেনে নিতে পারে না শুধু এজন্য যে তা যুক্তি-তর্ক ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থিত নয়। যুক্তি-তর্ক, আধুনিক-বিজ্ঞান কতোটুকু মানবতার জন্য উপকারি আর কতোটুকু মানবতার জন্য অপকারী, মানব সভ্যতার সুস্থতা বিকাশে ধর্মের অবদান আর বিজ্ঞানের অবদান কী? তা বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু মুসলমান হিসাবে যেহেতু আমরা নিজেদেরকে দাবি করছি তাই আপনাদের প্রতি আবেদন হল মুসলমান হিসাবে আমাকে পরিচয় দিতে হলে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আর যুক্তি-তর্কের ব্যাপারে এই দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমানত ও দিয়ানতের প্রতি আস্থা থাকার ভিত্তিতে তার থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত দ্বীনী সকল বিষয়গুলো মেনে নেওয়া। অতপর ঈমানী বিষয়গুলোর কোনটির ব্যাপারে ইতমিনান বা প্রশান্তি লাভের জন্য যুক্তিতর্ক বা বিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করতঃ সমর্থিত বিষয়গুলো মেনে নেয়া আর যা সমর্থিত নয় তাও নবীর আমানত ও দিয়ানতের ওপর আস্থা থাকার কারণে। তাহলে তাতে আমার ঈমানের কোন সমস্যা হবে না। দ্বীনি বিষয়ে পূর্ণ ঈমান থাকার পরও যুক্তি ও আকলের দ্বারা আরো বুঝা আরো বোধগম্য বা চিত্তপ্রশান্তি করা দোষণীয় নয়। এর একটি টাটকা উদাহরণ দিই আমাদের জাতীয় পিতা হযরত ইবরাহিম আ. এর জীবনী থেকেÑ কুরআনের ভাষায় পড়ি, (স্মরণ কর) যখন ইবরাহিম বললেন, হে আমার রব! আমাকে দেখিয়ে দিন কীভাবে আপনি মৃতদের জীবিত করবেন। আল্লাহ বললেন, তুমি কি বিশ্বাস কর না? তিনি বললেন, অবশ্যই; তবে (এ প্রার্থনা এ জন্য করছি যে, যাতে আমার অন্তর প্রশান্তি লাভ করে।’ আল্লাহ বলেন, ‘তাহলে চারটি পাখি ধরে আনো এবং পোষ মানিয়ে নাও। অতপর প্রত্যেক পাহাড়ের ওপর ওদের (দেহের )এক এক অংশ রেখে দাও, ওরা দৌড়ে চলে আসবে। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান। (বাকারা: ২৬০)
আমি যদি আমার দ্বীনি সকল বিষয়ে যুক্তি-তর্ক আর বিজ্ঞানের সূত্র সমর্থন খুঁজি এবং এগুলো দ্বারা সমর্থিত হলে মানি, না হলে মানি না। তাহলে কি আমার কাছে রাসুলের তুলনায় যুক্তিতর্ক আর জ্ঞান-বিজ্ঞান বেশি আস্থাভাজন হয়ে গেলো না? তাহলে নবী প্রেরণের স্বার্থকতা কোথায়? তাহলে কি যারা মুসলমান হয়েও শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান আর যুক্তি-তর্কে সমর্থিত বিষয়গুলো মানে তারা কাদিয়ানিদের ন্যায় এ নবীর উম্মত নয়, তারা হল অন্য এক নবীর উম্মত? হ্যাঁ, তারা এ- নবীর উম্মত নয় বরং তারা আধুনিক এক নবীর উম্মত যার স্রষ্টা হলো মানুষ। আর নবী হলো তার জ্ঞানপ্রসূত যুক্তি বিজ্ঞান সূত্র।
ইমাম মুহাম্মাদ রা. বলেন: ঈমানের পারিভাষিক অর্থ হল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে সমস্ত বিষয় অকাট্যভাবে প্রমানিত তা সত্যায়ন করা এবং দ্বীন বিরোধী সকল চিন্তা-চেতনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং এ সকল কিছুর প্রতি অসন্তোষের বহি:প্রকাশ ঘটানো। আল্লাহ তায়ালা বলেন- হযরত ইবরাহিম আ. এবং তার সঙ্গীদের মাঝে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ, যখন তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বজাতিকে উদ্দেশ্য করে, নিশ্চয় আমরা, তোমরা এবং আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদের ইবাদত কর তাদের থেকে মুক্ত। (মুমতাহিনা)
শায়খ আব্দুল কাদের জিলানী র. ছানাউল্লাহ পানিপতী ও শাহ ওয়ালীউল্লাহ র. প্রমুখ বলেন- ঈমানরে দু’টি দিক রয়েছে। একটি দিক হলো অন্তরে বিশ্বাস করে, মুখে স্বীকার ও কাজে পরিণত করা। আরেকটি দিক হলো নিজের ধ্যান-ধারনা ও চিন্তা-বিশ্বাসকে শরীয়ত অনুযায়ী বানানো। শরীয়ত যা চায়, পছন্দ করে তবীয়তও যেন সেই বস্তুই চায়। আর যে জিনিসকে শরীয়ত ঘৃণা করে, নিজের তবীয়তেও যেন মন থেকে তাকে ঘৃণা করে। (কাশফূল বারী, খণ্ড ১ পৃষ্ঠা: ৪৪৬)
ঈমান, দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা ও দ্বীনবিরোধী চিন্তা দর্শনের প্রতি অস্বীকৃতি ও ঘৃণার নাম
একথার পক্ষে কুরআনের বিবরণ আরো বোধগম্য ও সহজতর। ঘোষণা হচ্ছে- দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই, নিশ্চয় হেদায়াত গোমরাহি থেকে সুস্পষ্টরূপে পৃথক হয়ে গেছে। অতএব যে কেউ তাগুত কে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে, নিশ্চয় সে মজবুত হাতল আকড়ে ধরবে, যা ভেঙ্গে যাওয়ার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।(বাকারা-২৫৬)
কুরআনের অন্য এক বাণীতে আরো সরলময় গদ্যরূপে অঙ্কিত হয়েছে উক্ত বিষয়টি। তিনি বলছেন- আর জেনে রাখ, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসুল রয়েছেন। তিনি যদি বহু বিষয়ে তোমাদের কথা মেনে নেন, তবে তোমরাই কষ্টে পড়বে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করে দিয়েছেন, তোমাদের অন্তরে তা পছন্দনীয় করে দিয়েছেন এবং তোমাদের নিকট কুফুর, পাপ ও নাফরমানিকে ঘৃণিত করে দিয়েছেন। ঐরূপ লোক তারাই তো সৎপথপ্রাপ্ত। (হুজুরাত:৭)
আরো দু’ একটি আয়াত শোনা যাক এ ব্যাপারে- আপনি কি ওদের দেখেননি, যারা দাবী করে যে, ওরা আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে? ওরা নিজেদের মামলা তাগুত (মানব রচিত বিচারব্যবস্থা) এর কাছে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদের ওর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (নিসা-৬০) নিশ্চয় আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে (এ বার্তা দিয়ে) রাসুল পাঠিয়েছি, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করোএবং তাগুত (বাতিল উপাস্য) থেকে দূরে থাক। (নাহ্ল:৩৬)
আল্লাহর উল্লিখিত বাণী হতে বুঝা যায় যে,
.যার মাঝে তিনটি বস্তু বিদ্যমান থাকবে সে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ পাবে:-
১। যার নিকট আল্লাহ ও তার রাসুল দুনিয়ার সবকিছু থেকে বেশি প্রিয়।
২। যে আল্লাহর জন্যই কাউকে ভালবাসে।
৩। আর কুফুরি মতাদর্শে বিশ্বাসি হওয়াকে আগুনে পুরার মত অপছন্দ করে।
তাগুত শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয় যেমন মূর্তি, শয়তান, ভ্রান্ত মতবাদ, ভ্রান্ত মতবাদের প্রধান, সীমালঙ্ঘনকারী, জাদুকর, গনক, আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত করা হয় ইত্যাদি। সময়ের পরিবর্তনে তাগুতও চেহারা পাল্টায়। এ ব্যাপারে মনজুর নোমানি রহ. এর অভিমত পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আধুনিক কালের আধুনিক মূর্তি হল জাতি, দেশ, জাতীয় স্বার্থ, উদর, সম্পদ, শাসন ক্ষমতা প্রভৃতি।
সূরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াতের “মজবুত হাতল আকড়ে ধরা” এর ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ বলেন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন। আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের পরিচয় এই বাক্যের আগের বাক্যে দেওয়া হয়েছে এভাবে যে, তাগুত কে অস্বীকার এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এতোদুভয়ের সমন্বয় হল আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষনীয় যে, উল্লিখিত আয়াতে তাগুত কে অস্বীকারের স্থান প্রথম, এরপর আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এর দ্ধারা বুঝা যায় ঈমান বিল্লাহ তথা আল্লাহর ওপর ঈমান আনয়নের ক্ষেত্রে তাগুতকে অস্বীকারের গুরুত্ব কোন দিক থেকেই কম নয় এই জন্য ইসলামের প্রথম কালিমা; কালিমায়ে তায়্যিবায় তাগুতকে অস্বীকারের কথা আগে বলা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে লা-ইলাহা (কোন ইলাহ নেই) এরপর বলা হয়েছে ইল্লাল্লাহু (ইলাহ একমাত্র আল্লাহ) অর্থাৎ প্রথমে বাতিল সকল উপাস্যকে অস্বীকার এরপর এক আল্লাহর প্রতি ঈমান। কারণ অন্যের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা বা মনের টান, আল্লাহর প্রতি শতভাগ বিশ্বাস স্থাপনে অন্তরায় ।
সৎপথপ্রাপ্ত লোক কারা? আল্লাহ তায়ালা সূরায়ে হুজরাতের ৭নং আয়াতে তাদের পরিচয় দিয়েছেন যে, সৎপথ প্রাপ্ত ওই সকল ব্যক্তি যাদের নিকট ঈমান হল প্রিয় ও পছন্দনীয় বস্তু আর ঘৃণিত ও অপছন্দনীয় বস্তু হল কুফুর, পাপ ও আল্লাহর নাফরমানি। তাই সিরাতে মুসতাকিম পেতে হলে ঈমান ইসলাম আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশিত পথকে নিজের প্রিয় ও পছন্দনীয় বস্তু বানাতে হবে। কুফুর ও কুফুরি মতবাদসমূহকে নিজের কাছে অপছন্দনীয় ও ঘৃণিত বস্তুতে পরিণত করতে হবে।
সূরা বাকারার ১৬৫, ১৬৬ নং আয়াতে কাফের আর মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন যে, যারা কাফের তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদের প্রতি ভালবাসা রাখে আর যারা মুমিন তারা আল্লাহকে বেশি ভালোবাসে।
প্রত্যেক মতবাদ তার অনুসারিদের ব্যাপারে এ- কামনা করে যে, তার অনুসারির জীবনের সকল শাখা প্রশাখা ওই রং ধারন করুক যা তার মনপুত। ইসলামও এক্ষেত্রে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম নয়, ইসলামও চায় যে, তার অনুসারির জীবনের প্রতিটি ডাল পালা, পাতা পল্লবে তার রং ফুটে ওঠুক এবং বাস্তবতাও হল ইসলামের রঙেই সর্বোত্তম। আল্লহ তায়ালা একথাটা আরো বাঙময় করে তুলেছেন সুরা বারাকার ১৩৮ নং আয়াতে- (তোমরা আরো বল, আমরা গ্রহণ করেছি) আল্লাহর রং। আর আল্লাহর (রঙের) চেয়ে কার রং উত্তম? এবং আমরা তারই ইবাদত করি। (বাকারা:১৩৮)
কিন্তু বর্তমানে পশ্চিমা বাদ-মতবাদে বাজার সয়লাব, যার চোখ ধাঁধানো রংয়ের কারণে ইসলামের চোখ শীতল করা রংয়ের কদর অনেক কম। তাই অমুসলিমরাই শুধু নয় বরং মুসলমানেরাও ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে বস্তুবাদী দর্শনের চোখ ধাঁধানো রংয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন মুসলমানের জীবনের সবকিছু ঐ রং দিয়ে রাঙ্গানো। আর ইসলামের ছিটা-ফোটার কোথাও কোথাও দেখা মিলে। চিন্তার বিষয় হল সবকিছু অন্যের রঙ্গে রাঙ্গিয়ে মালিকের রঙ্গের ছিটে-ফোটা তাতে দিলে মাওলার দরবারে কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাবে তা মালিকেই ভালো জানেন।
দ্বীন অনেক সংবেনশীল ও আত্মমর্যাদাবান জিনিস, দ্বীনের প্রতি অবহেলা, তার কোন রকম অমর্যাদা বা সম্মানহানি সে কখনো সহ্য করে না। দ্বীনি অবদানের জন্য যে জাতি ইসলামী ইতিহাস স্বরণীয় ও বরণীয় তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম যখন কাবার কেবলা পরিবর্তন করে অন্য দিকে রুখ ফিরাল, শরীয়তে মুহাম্মদী ছেড়ে কাল মাকর্স আর লেলিনের মতবাদকে গ্রহণ করলো, দ্বীন সেখান থেকে সসম্মানে বিদায় নিয়ে অন্যত্র চলে গেল। আমাদের ব্যক্তি জীবন থেকে নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বীনের উপস্থিতিকে খারাপ ভাষায় বললে একমাত্র ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার তুলনার সাথেই তুলনা চলে। এতো এতো মুসলমান আর দ্বীনের একি করুণ অবস্থা ! আমরা যদি এখনো দ্বীনের প্রতি সম্মান আর ভালোবাসা না দেখাই, আমাদের মনের কেবলা যদি পরিবর্তন না করি, আত্মা যদি পড়ে থাকে মস্কো আর ওয়াশিংটনে, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র তাদেরকেই প্রধান্য দিই তাহলে আমাদের থেকে দ্বীন সসম্মানে বিদায় নিয়ে এমন জাতির নিকট চলে যাবে, যারা তাকে আন্তরিকতার সাথে সম্মানে গ্রহণ করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- হে ঈমানদারগন! তোমাদের মধ্যে যে নিজ ধর্ম ত্যাগ করবে , তো আল্লাহ তায়ালা শিঘ্রই এমন এক দল নিয়ে আসবেন , যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসেন এবং তারা আল্লাহকে ভালোবাসে। যারা হবে মুমিনদের প্রতি বিনয়ী এবং কাফেরদের ওপর কঠোর, যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। (মায়েদা: ৫৪)
অনেক মানুষ কাজের ফাঁকে, ছুটির সময় বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় ঘুরতে যায়। দর্শনার্থীদের পছন্দনীয় একটি জায়গা হল চিড়িয়াখানা বা জাদুঘর। অনেক সময় এগুলোতে দেখা যায় বিভিন্ন প্রাণীর মমিমূর্তি। মমিমূর্তিটা হল, অনেক সময় বন্যপ্রানী বনে বা চিড়িয়াখানার ভিতরে মারা যায়। তখন ওই প্রাণীর চামড়া খসিয়ে চামড়াটাকে শুকায়, তারপর ওই চামড়ার ভিতর কিছু ঢুকিয়ে জাদুঘর বা চিড়িয়েখানায় স্থাপন করে রাখে। দেখতে অবিকল ওই প্রাণীর মত। দাঁত, নখ, কান, চোখ সবই থাকে কিন্তু প্রাণীর এ- আকৃতি দেখে মনের ভিতর সেই ভয় সঞ্চার হয় না যা আসল প্রানী দেখলে হত। তাই তো আমাদের ছোট ছোট বাচ্চারাও গিয়ে এ- রকম বাঘ, সিংহের লেজ ধরে টানাটানি করে। তার ওপর চড়ে বসে। এর বিপরীত একজন লোক জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার সামনে একটি বাঘ এসে দাঁড়িয়ে গেল, তখন তার অবস্থা কেমন হবে? ভয়ে তার শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়ে যাবে। চেহারার রং বিবর্ণ হয়ে ভয়ে জিহ্বা শুকিয়ে যাবে। সমস্ত শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে শরীর থেকে টপটপ করে ঘামের ফোটা পরা শুরু হয়ে যাবে। এগুলোও হবে তার অজান্তে। কারণ তার সামনে সত্যিকারের বাঘ এসে উপস্থিত।
সোকেস বা ঘর সাজানোর জন্য অনেক সময় মার্কেট থেকে মাটির তৈরি আপেল,কমলা ও নানা রকমের ফলমূল কিনে আনা হয়। যার আকৃতি, রং মূল ফলের চেয়েও সুন্দর ও গাড়। কিন্তু কমলার যে ঘ্রাণ আর আপেলের যে স্বাদ তা এই মাটির তৈরি কমলা আর আপেলে পাবে কোথায়?
নকল ঈমান বা তার শুধু বাহ্যিক রূপের দৃষ্টান্ত হল ঐ বাঘ যা মমিকৃত, দেখতে অবিকল বাঘ মনে হলেও বাঘের গর্জন, ক্ষীপ্রতা আর সাহসিকতার বহিঃপ্রকাশ তার থেকে কখনো প্রত্যক্ষ করা যায় না। অথবা ঐ খেলনার কমলার ন্যায় যার রং মূল কমলার চেয়ে গাড়, আকৃতি মূল কমলা চেয়ে সুন্দর কিন্তু তার থেকে ঐ স্বাদ ও ঘ্রাণ পাওয়া যায় না। আর প্রকৃত ঈমানের দৃষ্টান্ত হল প্রকৃত বাঘ বা কমলার ন্যায়। যাদের মাঝে ঈমান ও ঈমানের হাকীকত দুটিই থাকে তাদের গর্জন, ক্ষীপ্রতা আর সাহসিকতার তুলনা তো বাঘের সাথেও চলে না কারণ তাদেরকে শুধু মানুষ নয় বরং ইবলিশ শয়তানেও ভয় পায়। তারা হয় আদর্শ আর অন্যরা হয় তাদের অনুসারি। তারা থাকে বিজয়ী অন্যরা বিজিত। অন্যরা তাদের স্বাদ উপভোগ করে, মাতোয়ারা হয়ে যায় তাদের ঘ্রাণে। ঘোর অন্ধকারও তাদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে যায়। কিন্তু যাদের নিকট রয়েছে শুধু ঈমানে খোলস, তার হাকীকত বা বাস্তবতা বলতে কিছু নেই, মুমিনের সুরত আছে, কিন্তু সিরত নেই, তারা তো প্রকৃত অর্থে মুমিন নয়। তারা হল মুমেনের মমি। তাকে তো তার মতোই অন্য একজন মানুষ বা তার চেয়ে শক্তিশালী শয়তান ভয় পাবে না। তার হুংকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হবে না বরং সে সদা বাতিলের ভয়ে আতঙ্কিত থাকবে।
যে কালিমা মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে দিতো। মনের চাওয়া-পাওয়া ও খায়েশাতকে দমিয়ে আল্লাহর রাস্তায় নিজের জান-মাল বিলিয়ে দেওয়ার প্রেরণা যোগাত, যে কালিমা থেকে দীক্ষা নিয়ে হাসি মুখে বরণ করতো অকথ্য জুলুম নির্যাতন, যার খাতিরে মাতৃভূমি ত্যাগ করে চলে যেতো বহুদূর কোন দেশে, সেই কালিমা আজ তার বিশ্বাসীকে নামাজের জন্য আরামের বিচানা ত্যাগ করাতে অক্ষম। মনের চাওয়া-পাওয়া ও খায়েশাতকে দমিয়ে আল্লাহর রাস্তায় নিজের জান-মাল বিলিয়ে দেওয়া। হাসি মুখে দ্বীনের জন্য অকথ্য জুলুম নির্যাতন সহ্য করার প্রেরণা যোগানো তো আরো পরের বিষয়। আজ আবু সালামা রা. এর মতো কোন মুমিনকে পাওয়া যায় না- যে কালিমার বলে বলীয়ান হয়ে স্ত্রী-সন্তানকে রাস্তায় ফেলে দ্বীনের জন্য পাড়ি জমাবে অজানা কোন গন্তব্যে। কোন সুহাইব রুমীর দেখা মিলে না যে দ্বীনের জন্য নিজের সর্বস্ব ছেড়ে ঈমানের দুর্গে আশ্রয় নিবে।
এখানে প্রশ্ন হল, যে কালিমা মানুষের জীবনে এতো বড় বিপ্লব সাধন করতো সেই কালিমা, সেই শব্দ এখনো তো আছে আগের সেই রঙে ঢঙে পুরানো সেই সাজে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়, কেন পারছে না তার বিশ্বাসীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন আনতে? এর উত্তর হল, আমাদের পূর্বসূরিরা শুধু কালিমার শব্দগুলোর বিশ্বাসী ছিলেন না বরং তার হাকীকতেরও বিশ্বাসী ছিলেন। আর আমরা সারশূন্য শুধু কালিমার শব্দগুলো আওড়াই, তার তাৎপর্য ও হাকীকত আমাদের অন্তকরণে টুকাই না আর প্রবেশ করালেও স্থায়ী হয় না। যার দরুন আমাদের জীবনের ওপর কালিমার সেই প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না, যে প্রভাব আমাদের পূর্বসূরীদের মাঝে দেখা যেত।
আমরা সারশূন্য কালিমা দ্ধারা সেই ফলাফলের আশা করি, তা দ্বারা যে ফলাফল সাহাবায়ে কেরাম, আমাদের আকাবিরগণ পেয়েছিলেন। নামাজ, রোযা ও অন্যান্য ইবাদতের ক্ষেত্রেও তাই। আমরা কঠিন মূহূর্তগুলোতে বলে থাকি আমরা কি মুসলমান নয়? আমরা কি নামাজ পড়ি না? রোযা রাখি না? ইত্যাদি ইত্যাদি অতএব আল্লাহ তায়ালার সাহায্য আসবে না কেন? কিন্তু মরে রাখতে হবে মাটির তৈরি খেলনার আপেল থেকে কখনো আপেলের স্বাদ আর গুনাগুন পাওয়া যায় না। নকল জিনিস দ্বারা কখনো আসলের ন্যায় উপকৃত হওয়া যায় না। ঈমানের সুরত দিয়ে বাতিলের বিরুদ্ধে বিজয়ের স্বাদ উপভোগ করা যায় না। আল্লাহ বলেন- তোমরা হীনবল হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা ঈমানের হাকীকতের অধিকারী হও।
লক্ষণীয় বিষয় হল উল্লিখিত আয়াতে সম্বোধিত ব্যক্তিরা মুমিন, কাফের নয় তারপরেও তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে বিজয়ী হতে হলে মুমিন হতে হবে অর্থাৎ শুধু মুমিনের সুরত ধারন করাই বিজয় লাভের জন্য যথেষ্ট নয় বরং প্রকৃত অর্থে মুমিন হতে হবে, থাকতে হবে মুমিনের সিরত-সুরত দুটিই সমান তালে।
হযরত ঈসা আ. তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমরা যমীনের লবন স্বরূপ, লবনের লবনাক্ততা যদি চলে যায় তাহলে খাবারকে লবনাক্ত করবে কোন জিনিস?
দ্বীনের যারা ধারাক বাহক ঐ সমস্ত দ্বীনি ভাইদেরকে বলবো আপনারা তো প্রকৃত ঈমানের ধারক বাহক। আল্লাহ না করুন যদি আপনাদের ঈমান, ইসলাম হাকীকত শূন্য হয় তাহলে আমাদের মতে সাধারণেরা ঈমানের হাকীকত আর ইসলামের হাকীকত পাবো কোথা থেকে?
উলামায়ে কেরাম যদি ঈমানের চেতনা প্রেরণা খালি হন তাহলে সাধারণ মানুষ চেতনা পাবে কোথায় থেকে?
মুসলিম মিল্লাত যদি রুহানিয়্যাত শূন্য হয় তাহলে মানবজাতি রুহানিয়্যাত পাবে কোথায় থেকে?

 

শেয়ার করুন

আরো পড়ুন

যোগদিন আমাদের সাথে

ইসলামের মূল তিন কাজ- তা’লীমে দ্বীন (দ্বীনের শিক্ষা), তাবলীগে দ্বীন (দ্বীনের দাওয়াত) ও তাগলীবে দ্বীন (দ্বীনের বিজয়) এর সমন্বয়ে ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য পাঁচ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ১. দাওয়াত, ২. সংগঠন, ৩. প্রশিক্ষণ, ৪. সমাজকল্যাণ, ৫. আন্দোলন। আমি বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস ঘোষিত কর্মসূচির সাথে একাত্মতা পোষণ করছি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এ সংগঠনে যোগদান করছি।

Scroll to Top