আমাদের লক্ষ্য অর্জনের পর্যায়ক্রমঃ মুহাম্মাদ জাহিদুজ্জামান

আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুলকে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন যেমন উম্মতকে শিক্ষা দেয়া, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করা ইত্যাদী। তবে এগুলো হল আনুষাঙ্গিক লক্ষ্য। চূড়ান্ত লক্ষ্য হল, আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা। শেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুনিয়াতে প্রেরনের যে সকল উদ্দেশ্য আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেছেন তন্মদ্ধে মৌলিক লক্ষ্য ছিল আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা। পবিত্র কুরআনে সুরা সফের ৯ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে, “আর তিনি স্বীয় রাসুলকে হেদায়েত ও সত্য ধর্ম দিয়ে প্রেরণ করেছেন যেন তিনি (রাসুল সা.) এই দ্বীনকে অন্য সকল মতাদর্শের উপর বিজয়ী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন”। শুধু আখেরি পয়গম্বর নন বরং পূর্ববর্তী অন্যান্য নবীদের প্রেরণের উদ্দেশ্য আল্লাহ তায়ালা বর্ণনা করেছেন: “নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি ¯পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সঙ্গে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমি লোহাও দিয়েছি যাতে রয়েছে প্রচণ্ড রণশক্তি ও মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ এবং এ জন্য যে, আল্লাহ প্রকাশ করবেন কে প্রত্যক্ষ না করেও তাঁকে ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী”। – (সূরা হাদীদ: ২৫)
এর অর্থ হল আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির মাঝে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নবীগণকে শক্তি প্রদান করেছেন। আর ইনসাফ প্রতিঠিত হলেই আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হবে। অর্থাৎ সমস্ত নবীদের কে প্রেরনের যে লক্ষ্যগুলো আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করেছেন তার মধ্যে মৌলিক একটি লক্ষ্য হল আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা।
যতদিন পর্যন্ত দ্বীন বিজয়ী না হবে ততদিন পর্যন্ত মুমিনের লক্ষ্য অর্জন হয়েছে তা আমরা মনে করতে পারি না। এ লক্ষ্যটা অনেক মহৎ । এটা বিরাট এক সাধনা ও সংগ্রামের ব্যাপার। সমস্ত বাতিল মতাদর্শকে পরাস্ত ও পরাজিত করে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয় করা অবশ্যই খুব সহজ কাজ নয়। বাতিল মতাদর্শ খোদাদ্রোহী সকল আদর্শকে পরাভূত করা চাট্টিখানি কোন ব্যাপার নয়। দ্বীন বিজয়ের কর্মীদের যেমন তৎপরতা রয়েছে দ্বীনকে পরাজিত করে গাইরুল্লাহর মতাদর্শকে বিজয় করার লক্ষ্যে যারা কাজ করছে তাদের তৎপরতা আরো বেশি। তাই আমরা যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি বাহ্যিকভাবে সেটাকে সুদূর পরাহত একটি বিষয় মনে হতে পারে।
স্বাভাবিকভাবেই মানুষের সামনে যখন তার গন্তব্যে পৌঁছা অসম্ভব বা সুদূর পরাহত মনে হয় তখন ওই গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রতি সে কোনো প্রেরনা পায় না। যখন সে উপলব্ধি করে যে এ পর্যন্ত পৌঁছা আমার পক্ষে সম্ভবই না তখন সে ওই পর্যন্ত যেতে কার্যকর কোনো চেষ্টা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করতে পারে না। ঠিক তেমনিভাবে লক্ষ্য যদি কোন দূরবর্তী বিষয় হয় তাহলেও সেদিকে চলতে তার অনেক কষ্ট হয়। আর গন্তব্য বা টার্গেট যদি খুব কাছে হয়, যদি মনে হয় এই তো সামনেই আমার গন্তব্য তখন সেদিকে পথ চলতে সে বাড়তি অনুপ্রেরনা লাভ করে।

যেমন ধরুন, ঢাকা থেকে কারো বাড়ি অনেক দূরে। দেশের বাড়ির দিকে যখন সে যাত্রা শুরু করে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বাসস্ট্যান্ডে যায়, সেখান থেকে বাসে করে অনেক দূরে জেলা শহরে নামে। সেখান থেকে রিক্সায়/অটোতে বাড়ির কাছাকাছি কোথায় নেমে কিছু পথ হয়ত হেটে বাড়িতে পৌঁছে। তো বাসস্ট্যান্ড থেকে জেলা শহর সেখান থেকে রিক্সায় বাড়ির কাছাকাছি যাওয়া এই দীর্ঘ সফরের পর অনেক সময় গভীর রাত হয়ে পুরা এলাকা অন্ধকারে ছেয়ে যায় বা রাস্তা অমসৃণ থাকে, কখনো ঝড় বৃষ্টি হয়, কিন্তু যত প্রতিকূলতা থাকুক ঐ সময় পথ চলতে কোন তার কোন ক্লান্তি অনুভব হয় না, বরং রিক্সা থেকে নেমে বাকি পথটুকু হাটতে বাড়তি একটা অনুপ্রেরনা লাভ করে। তখন তার কাছে কোন ক্লান্তিই আর ক্লান্তি মনে হয় না। তখন সে ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে সমস্ত কাদা মাটি মাড়িয়ে, রাতের অন্ধকারেই দ্রুত গতিতে পথ চলতে থাকে; কারন তখন সে মনে করে এই তো একটু সামনেই আমার বাড়ি। সে বাড়িতে গেলেই মায়ের সান্নিধ্য পাওয়া যাবে, দীর্ঘদিন পর আপনজন, বাবা-মা ভাইবোনদের সাক্ষাত পাওয়া যাবে। নিজের মধ্যে বিদ্যমান এই আগ্রহটা তার পথের সকল ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দেয়।

খায়বার বিজয় করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় ফিরছিলেন। ফিরার পথে যখন ওহুদ পাহাড় তাঁর দৃষ্টির সীমানায় এসে পড়লো, তখনই নবী সা. এর চেহারায় নতুন এক উদ্দীপনা ফুটে উঠলো, চলার মধ্যে গতি সঞ্চার হল, তিনি আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়লেন, আর মুখে বলে উঠলেন “এটা ওই পাহাড় যা আমাদেরকে ভালোবাসে আমরাও যাকে ভালোবাসি”। একথা বলে তিনি দ্রুত চলতে থাকলেন। কারণ ওহুদ পাহাড় হল মদীনার প্রতীক। মদীনা যখন চোখের সামনে এসে পড়েছে সাথে সাথে চলার মধ্যেও গতির সঞ্চার হয়েছে। অর্থাৎ নবীদের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে যে গন্তব্য ও লক্ষ্য যখন চোখের সামনে ছিল তখন চলার মধ্যে বাড়তি গতির সঞ্চার হয়েছে।
বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস খ শাখা তার সুনির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংগঠন তার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তা হল এ’লায়ে কালিমাতুল্লাহ তথা আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা। আমাদের সংগঠন এমন একটি লক্ষ্যকে নিজেদের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে যেটা নবীদের মৌলিক একটি লক্ষ্য ছিল। আমাদের সংগঠনের লক্ষ্য খুব সংক্ষিপ্ত ও অত্যন্ত পরিষ্কার।
আমাদের লক্ষ্য চলার পথকে আরো গতিশীল ও অনুপ্রানীত করার জন্য একে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। এটাই হল “আমাদের লক্ষ্য অর্জনের পর্যায়ক্রম”। অর্থাৎ লক্ষ্যটাকে ভাগ করে চোখের সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। যাতে এ পথে চলতে কর্মীরা আলাদা অনুপ্রেরনা লাভ করে। আমাদের লক্ষ্য হল এ’লায়ে কালিমাতুল্লাহ তথা আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা। এই লক্ষ্য অর্জনের চারটি পর্যায় হল-
১. ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ যোগ্য ব্যক্তি গঠন।
২. আদর্শ ইসলামী সমাজের পরিবেশ গড়া।
৩. বাতিল প্রতিরোধ ও ইসলামের গৌরব রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন।
৪. রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বাত্মক সংগ্রাম করা

১. ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ যোগ্য ব্যক্তি গঠন
আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রথম ধাপ হল, একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তি জীবনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয় করবে। একজন ব্যক্তি যখন ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হবে তখনই তার পক্ষে ব্যক্তি জীবনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয় করা সম্ভব হবে। ব্যক্তি জীবনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয় করার অর্থ হল, ব্যক্তি তাঁর জীবন চলার পথে প্রতিমুহূর্তে বিপরীতমুখী দুটি হুকুমের সম্মুখিন হয় ১.আল্লাহর হুকুম ২. বাতিল/শয়তানের হুকুম। যেমন: আযান। আল্লাহর পক্ষ থেকে এটি একটি আহ্বান ও নির্দেশ যে, মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামাজ আদায় কর। ঠিক এই মুহূর্তে শয়তানের পক্ষ থেকে এমন কিছু আয়োজন ও প্রণোদনা থাকে যে তুমি নামাজে যেও না। এখন যদি সে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করে তাহলে আল্লাহর দ্বীন এখানে বিজয় হল। আর যদি শয়তানের কথা অনুযায়ী নামাজ না পড়ে তাহলে এখানে শয়তান ও তাগুতি শক্তি বিজয়ী হল আল্লাহর দ্বীন পরাজিত হল। ঠিক এমনিভাবে তার চলা-ফেরা, খাওয়া-দাওয়া, ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী দুটি হুকুমের সম্মুখিন হয়। যদি আল্লাহর হুকুমকে সে প্রাধান্য দিতে পারে তাহলে তার ব্যক্তিজীবনে আল্লাহর দ্বীন বিজয় হল, আর যদি শয়তানের হুকুমকে প্রাধান্য দেয় তাহলে শয়তানের হুকুম বিজয় হল। ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ একজন ব্যক্তি সে আল্লাহর সমস্ত হুকুম পালনে সর্বদা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবে তার জীবনে আল্লাহর দ্বীনই বিজয়ী হবে শয়তানের হুকুম কখনো বিজয়ী হতে পারে না। এটা হল দ্বীন বিজয়ের প্রথম ধাপ।
২. আদর্শ ইসলামী সমাজের পরিবেশ গড়া
ইসলাম হল এমন একটি জীবনব্যবস্থা যা একাকী যথাযথ ও পরিপূর্ণভাবে পালন করা সম্ভব নয়। ইসলামের ৫০-৬০% বিধান হয়ত একজন ব্যক্তি একাকী পালন করতে পারবে কিন্তু আরো অনেক বিধান রয়েছে যেগুলো শতচেষ্টা করেও একাকী পালন করা সম্ভব নয়। যেমন, জামাতে নামাজ ইসলামের একটি বিধান। একাকী কেউ জামাত করতে পারবে না বরং তার জন্য আরো মানুষ লাগবে, একটা জামাত লাগবে। এমনিভাবে হজ্জ, দুই ঈদের নামাজ, জিহাদ ইত্যাদী বিধান এগুলো একাকী পালন করা সম্ভব নয়। এজন্য ইসলামকে যদি এককভাবে পালন করা হয় তাহলে তার রূপটা এক রকম হয় আর যদি একটি জামাত বা সমাজ সঙ্ঘবদ্ধভাবে পালন করে তাহলে সেখানে ইসলামের ভিন্ন একটা রূপ ও সৌন্দর্য ফোটে ওঠে। আর এটাই হল ইসলামের আসল ও কাক্সিক্ষত রূপ। এবং আল্লাহর কাছেই এটাই সবচেয়ে প্রিয়।
যখন প্রথম ধাপ তথা ব্যক্তি জীবনে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হয়, একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিজীবনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয় করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। তাহলে তার জীবনে আল্লাহর দ্বীন বিজয় হল। এভাবে একজন দুজন দশজন করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যক্তি প্রত্যেকেই তার ব্যক্তিজীবনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয় করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলে প্রত্যেকের জীবনে ইসলাম বিজয় হল, এখন তারা সকলে মিলে যদি জামাতবদ্ধভাবে আল্লাহর হুকুম পালন করতে চায় তাহলে তাদের মধ্যে ইসলাম বিজয় হওয়ার চমৎকার একটি রূপ ফুটে উঠবে। তখন ইসলাম বিজয় হওয়ার ২য় ধাপ অর্জিত হবে। একাকী ইসলাম পালন করলে ইসলাম ততটা বিজয় হয় না সকলে মিলে জামাতবদ্ধতভাবে পালন করলে যতটা বিজয় হয়। একটি সমাজ যখন ইসলাম পালন করলো তখন ইসলাম বিজয় হওয়ার দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রান্ত হল। ইসলামের সৌন্দর্য আরো চমৎকারভাবে ফুটে উঠলো।
৩. বাতিল প্রতিরোধ ও ইসলামের গৌরব রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন
ইসলামবিরোধী যে কোন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার মত শক্তি অর্জনই হল ইসলামকে বিজয়ী করার তৃতীয় ধাপ। যে সমাজে আল্লাহর দ্বীনকে কটুক্তি করা, আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি কটু বাক্য বাবহার অথবা ইসলামের বিধিবিধানকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা বা ইসলাম বিরোধী কোন কার্যকলাপ পরিচালনার পর তার কোন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ হয় না সে সমাজে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় প্রতিষ্ঠিত আছে তা বলা যায় না। যেমন ধরুন যে এলাকায় আপনার উপর আঘাত আসার পর পাল্টা প্রতিকার হয় না সেখানে আপনার প্রভাব আছে তা প্রমানিত নয়। বরং প্রভাব থাকার প্রমান হল যে আপনার উপর আঘাত আসার পর এমনভাবে প্রতিকার করা হবে যে সে পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হবে। অতএব, যখন কোন সমাজে বাতিল শক্তির ইসলাম বিরোধী কোন কার্যক্রম পরিচালিত হলে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠে সেখানে ইসলামের গৌরব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। আর এ পর্যায়ে উন্নিত হলেই দ্বীন বিজয়ের তৃতীয় স্তর অর্জিত হবে।
৪. রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বাত্মক সংগ্রাম করা
রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত তথা খেলাফত কায়েমের লক্ষ্যে সর্বাত্মক সংগ্রাম করা। শুধুমাত্র ইসলামের বিরোধিতা করা যায় না এমন নয় বরং রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রম ইসলাম অনুযায়ী পরিচালিত হবে তা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ বিরোধিতা পরিত্যাগের পাশাপাশি আনুগত্য তৈরি করাই হল এ পর্যায়ের কাজ। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি আল্লাহর আইন ও বিধানকে মানতে বাধ্য থাকবে। প্রতিটি স্তর আল্লাহর বিধান অনুযায়ি চলবে। অর্থাৎ খেলাফত প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ের চতুর্থ ও চূড়ান্ত স্তর অর্জন করতে হবে।

একটি লক্ষনীয় বিষয়
এখানে এ বিষয়টি ¯পষ্ট হল যে মূল লক্ষ্য হল দ্বীনকে বিজয়ী করা। শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাবে দ্বীনকে বিজয়ী করা মূল লক্ষ নয়। হ্যাঁ, দ্বীনকে বিজয়ী করার একটা পর্যায়ে এসে রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীনকে বিজয়ী করতে হয়। তবে রাষ্ট্রীয় ভাবে দ্বীনকে বিজয়ী করার পূর্বেও আরো অনেক স্তর রয়েছে। যে বা যারা সেগুলোকে অতিক্রম করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বীনকে কায়েম করতে পারবে প্রকৃতপক্ষে সেখানেই দ্বীন বিজয়ী হবে।

স্তরবিন্যাসের সুফল
মূল লক্ষ্যটাকে চারটা পর্যায়ে বিভক্ত করার দ্বারা উল্লেখযোগ্য দুটি সুফল অর্জিত হবে।

ক. লক্ষ্য উদ্দেশ্যের কিছু কিছু বিষয় সামনে এসে পড়ায় তা সহজেই আয়ত্বে আনা যায়।
কারণ একজন ব্যক্তির নিজ জীবনে দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য শুধুমাত্র নিজ সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। এমনিভাবে একটি রাষ্ট্রের তুলনায় একটি সমাজে দ্বীন বিজয়ী করা সহজ। যদি শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দ্বীনকে বিজয়ী করার কথা বলা হত তাহলে তা সুদূর পরাহত মনে হত। আর লক্ষ যদি সুদূর পরাহত হয় তাহলে তা পূরণে অনুপ্রেরনা পাওয়া যায়না। আর লক্ষ্য যদি দৃষ্টিসীমানায় থাকে তাহলে তা অর্জনে বাড়তি প্রেরনা পাওয়া যায়।
খ. লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।
একজন মানুষ যখন লক্ষ্যের দিকে চলতে থাকে তখন তার লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। লক্ষ্যচ্যুত হওয়া থেকে বাচার কার্যকর একটি পন্থা হল এর পূর্বে কিছু উপলক্ষ্য বানিয়ে নেয়া। যেমন কেউ মুহাম্মাদপুর থেকে গুলিস্তান যাবে, ভুলে সে বাসস্ট্যান্ড থেকে মিরপুরের গাড়িতে ওঠে বসলো। কিন্তু মাঝে আর যাচাই করলো না যে সে কোথায় যাচ্ছে। তাহলে দীর্ঘ সময় গাড়িতে চড়ে মিরপুরে পৌঁছার পর সে বুঝতে পারবে যে ভুলপথে এসেছে। পক্ষান্তরে যদি সে তার লক্ষ্যকে কয়েকটি উপলক্ষে বিভক্ত করে নিত তাহলে কিছুদুর যাওয়ার পরই সে বুঝতে পারতো যে সে ভুল পথে যাচ্ছে। মুহাম্মাদপুর থেকে গুলিস্তান যাওয়ার ক্ষেত্রে যদি লক্ষ্যকে এভাবে ভাগ করে নেয়া হয় যে প্রথমে গাড়ি সাইন্সল্যাব পৌঁছবে সেখান থেকে শাহবাগ অতঃপর মৎসভবন হয়ে পল্টন এরপর গুলিস্তান। তাহলে মিরপুরের গাড়িতে উঠলেও যখন আমি দেখবো যে গাড়ি সাইন্সল্যাব না গিয়ে শ্যামলী গিয়েছে তাহলে দ্রুত আমার ভুল বুঝতে পেরে গাড়ি থেকে নেমে সঠিক গন্তব্যের দিকে ফিরে আসতে পারবো। এতে করে ভুলটা দ্রুত ধরা পড়ার সাথে সাথে সময়ও বেঁচে যাবে।

তাই চূড়ান্ত লক্ষ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বীনকে বিজয়ী করার পূর্বে কিছু উপলক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের পূর্বে এই ধাপগুলো অতিক্রম করতে হবে। কিছুদিন সংগঠন করার পর যদি আমি দেখি আমার ব্যক্তি জীবনে দ্বীন বিজয়ী হচ্ছে তাহলে বুঝবো আমি দ্বীন বিজয়ের ক্ষেত্রে সঠিক পথে রয়েছি। আর যদি দেখি যে কিছুদিন সংগঠন করার পর ব্যক্তি জীবনে দ্বীন বিজয়ী হওয়া তো দূরের কথা খাহেশাতে নফসানী বিজয়ী হচ্ছে; আগে আমার ভিতরে নেতৃতের লোভ ছিলো না, সংগঠন করার পর তা তৈরি হচ্ছে, আগে আমি জামাতে নামাজ পড়তাম সংগঠন করার পর এর গুরুত্ব দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, আগে আমার ভিতরে ধোঁকা, প্রতারনা ছিলো না এখন এই সিফাতগুলো পয়দা হচ্ছে যেগুলো শয়তানের আদর্শ তাহলে বুঝবো আমি সঠিক পথে নেই, এই সংগঠন আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করছে না। আমার জীবনে দ্বীন বিজয়ী হচ্ছে না।
ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন এ বিষয়টি প্রযোজ্য সংগঠনেরও তেমনিভাবে এটা বিশেষ বিবেচ্য যে, কিছুদিন পথচলার পর সংগঠন যদি দেখে যে সংগঠনের সদস্যরা প্রকৃতভাবেই নিবেদিতপ্রাণ যোগ্য হিসেবে গড়ে উঠছে, তাদের ব্যক্তি জীবনে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হচ্ছে তাহলে বুঝবে যে সংগঠন তার লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রথম ধাপ অতিক্রম করছে। আরেকটু অগ্রসর হয়ে যখন দেখবে কর্মীদের মাঝে সংঘবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে একে অপরকে সংঘবদ্ধভাবে দ্বীন পালনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করছে তাহলে দ্বিতীয় ধাপ অর্জিত হচ্ছে। এরপর ইসলামের উপর আঘাত আসলে সংগঠন ও সংগঠনের কর্মীরা কোন ব্যক্তিস্বার্থ বা ক্ষমতার জন্য নয় বরং একমাত্র আল্লাহর জন্যই ময়দানে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে তাহলে বুঝা যাবে সংগঠন সঠিক পথে চলছে। এ লক্ষ্যমাত্রায় যদি চলতে থাকে তাহলে আল্লাহর দ¦ীনকে বিজয়ী করে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আর যদি এর বিপরীত হয়, আগে মাথায় টুপি শরীরে সুন্নতি লেবাস ছিল এখন আর নেই। আগে সাহাবাদের নকশা কর্মীদের মাঝে ফুটে ওঠতো এখন শয়তানের নকশা ফুটে ওঠে। তাহলে এই সংগঠনের মাধ্যমে দ্বীনের বিজয় হওয়া সম্ভব নয়। যে সংগঠন তাদের কর্মীদেরকে মদীনার লেবাস থেকে ইউরোপীয় লেবাসে ওঠায় তা কখনো দ্বীনি সংগঠন হতে পারে না। আর এগুলো বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানেরও প্রয়োজন নেই এবং খুব বেশিদিন অপেক্ষারও দরকার নেই। বরং অল্পদিনের মাঝেই এটা নির্ণয় করা সম্ভব।

আমাদের সংগঠনের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে প্রথম তিনটি লক্ষ্য এমন যা অল্প পরিশ্রমের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। সংগঠনের মাধ্যমে একজন নিবেদিতপ্রাণ যোগ্যব্যক্তি গঠন করতে পারাটাও সংগঠনের জন্য সার্থকতা। আল্লাহর রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর শপথ! যদি তোমার মাধ্যমে আল্লাহ একজন ব্যক্তিকে হেদায়াত দান করেন, তবে তোমার জন্য তা সর্বাধিক মূল্যবান স¤পদ লাল উট অর্জন হওয়ার চেয়েও উত্তম” (বুখারী ও মুসলিম)। এরপর ইসলামী সমাজের গড়ে উঠলে নিজেদের মধ্যে বাড়তি অনুপ্রেরনা ও শক্তি অর্জিত হবে যার দ্বারা বাতিল প্রতিরোধ ও ইসলামের গৌরব রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা যাবে। আর এই লক্ষ্যগুলোর উল্লেখযোগ্য মাত্র খুব অল্প সময়েই অর্জন করা সম্ভব। এভাবে ছোট ছোট লক্ষ্যগুলো অর্জনের মাধ্যমে আমরা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যাব। ইনশাআল্লাহ।

 

শেয়ার করুন

আরো পড়ুন

যোগদিন আমাদের সাথে

ইসলামের মূল তিন কাজ- তা’লীমে দ্বীন (দ্বীনের শিক্ষা), তাবলীগে দ্বীন (দ্বীনের দাওয়াত) ও তাগলীবে দ্বীন (দ্বীনের বিজয়) এর সমন্বয়ে ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য পাঁচ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ১. দাওয়াত, ২. সংগঠন, ৩. প্রশিক্ষণ, ৪. সমাজকল্যাণ, ৫. আন্দোলন। আমি বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস ঘোষিত কর্মসূচির সাথে একাত্মতা পোষণ করছি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এ সংগঠনে যোগদান করছি।

Scroll to Top