কুরআন অধ্যয়ন: কিছু নির্দেশনা -মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল হুসাইন

আল কুরআনুল কারীম
মহান আল্লাহ তায়ালা বিশ্ব মানবজাতির হেদায়াত এবং মুক্তির জন্য নাযিল করেছেন মহাগ্রন্থ আল কুরআন। আল কুরআন হলো বিশ্ব মানবতার মুক্তির একমাত্র সনদ ও গ্যারান্টি। এ ছাড়া বিশ্ব মানবতা মুক্তি পেতে পারে না। এতে রয়েছে মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট হিদায়াত ও দিক নির্দেশনা, রয়েছে আলোকবর্তিকা, উপদেশ, রহমত ও অন্তরের যাবতীয় ব্যাধির উপশম। আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা’য়ালা বলেন,
হে মানুষ! তোমাদের রবের পক্ষ হতে তোমাদের কাছে এসছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা, আর মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত। বল আল্লাহর অনুগ্রহে ও রহমাতে। সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তার চেয়ে উত্তম। (সুরা ইউনুস- ৫৭)
আলিফ-লাম-রা; এটি এমন এক কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি যাতে আপনি মানবজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন পরাক্রান্ত প্রশংসার যোগ্য পালনকর্তার নির্দেশে তাঁরই পথের দিকে (সুরা ইবরাহীম-১)
কুরআনী সংবিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনার  মধ্যেই  নিহীত রয়েছে মানবজাতির ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি। সুতরাং যারা এ’লায়ে কালিমাতুল্লাহ তথা আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের স্বপ্ন বুকে লালন করে এবং কুরআনী সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে চায়, কুরআনের সাথে তাদের সম্পর্ক অবশ্যই অনেক গভীর হতে হবে। কুরআনের মর্মবাণী বুঝতে হবে। পরিকল্পনার আলোকে কুরআনের উপর মেহনত করতে হবে।
কুরআন তেলাওয়াত: প্রত্যেক মুমিনের উপর পবিত্র কুরআনের এই হক রয়েছে যে, মুমিন নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করবে। যারা সাবলীলভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে তারা পরিকল্পনার আলোকে কুরআন খতম করবে। প্রতি চল্লিশ দিনে এক খতম করার চেষ্টা করবে। তা সম্ভব না হলে দুই বা তিন মাসে খতম পূর্ণ করার চেষ্টা করবে। রমজান মাসে বিশেষ পরিকল্পনার আলোকে কুরআন তেলাওয়াত করবে। যারা সহীহ-শুদ্ধ বা সাবলীলভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারে না তারা সহীহ তেলাওয়াত শিক্ষার পরিকল্পনা নিয়ে সাধ্যমত কুরআন তেলাওয়াত করবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ সামর্থের আলোকে কুরআন তেলাওয়াতের পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। প্রয়োজনে দায়িত্বশীলের পরামর্শ নিবে।
মধুর সুরে কুরআন তেলাওয়াত:
মুমিনের জন্য বিশেষভাবে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীর জন্য কোনমতে কুরআন তেলাওয়াত কাম্য নয়। বরং মুমিনের কুরআন তেলাওয়াত যেমনিভাবে বিশুদ্ধ হবে তেমনিভাবে মুমিন মহান আল্লাহর কালাম অত্যন্ত সুন্দরভাবে সুমধুর কণ্ঠে, সুমিষ্ট স্বরে তেলাওয়াত করবে। ধীরস্থীরভাবে তারতীলের সহিত তেলাওয়াত করবে। মহান আল্লাহ তার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তারতীলের সাথে কুরআন তেলাওয়াত করতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে- “আর আপনি সুবিন্নস্তভাবে ও সুস্পষ্টভাবে কুরআন তেলাওয়াত করুন”। (সুরা মুযযাম্মিল- ০৪)
“তারতীল” এর অর্থ হলো সহজ ও সঠিকভাবে বাক্য উচ্চারণ করা, দ্রুত কুরআন তেলাওয়াত না করা বরং সহজভাবে এবং অন্তর্নিহিত অর্থ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে উচ্চারণ করা। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, পৃষ্ঠা নং- ১৪১৪)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামও সুমধুর কন্ঠে তারতীলের সাথে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। হাদিস শরীফেও এর অনেক তাকিদ বর্ণিত হয়েছে- হযরত য়া’লা ইবনে মামলাক থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রা. কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কুরআন তেলাওয়াত ও নবীজির নামাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। হযরত উম্মে সালামা রা. উত্তরে বললেন, তোমাদের নামাজ আর তাঁর নামাজের মাঝে তো আকাশ পাতাল ব্যবধান রয়েছে। তিান (রাতে) নামাজ পড়তেন অতপর নামাজ পড়া পরিমাণ সময় ঘুমাতেন, অতপর যে পরিমাণ সময় ঘুমিয়েছেন সে পরিমাণ সময় নামাজ আদায় করতেন। অতপর আবার ততটুকু পরিমাণ সময় ঘুমুতেন এভাবেই সকাল হয়ে যেত। এরপর উম্মে সালামা রা. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কুরআন তেলাওয়াতের বিবরণ এভাবে দিলেন যে, নবীজির কেরাত ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং সুবিন্নস্ত। প্রতিটি হরফ আলাদা আলাদা উচ্চারণ করতেন।  তিরমিযি শরীফ, হাদিস নং- ২৯২৩
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণিত- হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন যে, কিয়ামতের দিন ছাহেবে কুরআনকে বলা হবে, পড়তে থাক এবং বেহেশতে মর্যাদার স্তর সমূহে আরোহণ করতে থাক এবং থেমে থেমে পড়ো যেভাবে দুনিয়াতে থেমে থেমে পড়তে। কেননা তোমার আখেরী মনযিল তাই হবে, যেখানে শেষ আয়াত পৌছবে। তিরমিযি, হাদিস নং- ২৯১৪
কুরআন অধ্যয়ন
মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল কারীমকে বিভিন্ন অনুবাদ ও তাফসীর গ্রন্থের সাহায্যে গভীর মনোযোগের সাথে পাঠ করে তার থেকে শিক্ষা অর্জন করত নিজেদের জীবনকে কুরআনের আলোয় আলোকিত করা। যারা দ্বীন কায়েমের স্বপ্ন দেখে এবং কুরআনী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগ্রামে চেষ্টারত, তাদেরকে  অবশ্যই  কুরআনের  মর্মবানী ও বিধিবিধানগুলো গভীরভাবে  উপলব্ধি  করতে হবে। কারন কর্মী  নিজেই  যদি কুরআনের  মর্ম না বুঝে ,তাহলে কুরআন ভিত্তিক সমাজ কিভাবে কায়েম করবে? এ জন্য দায়িত্বশীলের  সাথে পরামর্শ করে পরিকল্পনার  আলোকে  কুরআনে কারীম অধ্যয়ন করতে হবে।
দারসুল কুরআন
“আল-কুরআনের ছোট সূরা বা কিছু অংশ নির্বাচন করে বিশুদ্ধ তাফসীর গ্রন্থের সাহায্যে তার আলোচনা পর্যালোচনা শেষে সার-নির্যাস বের করে নিজের জীবনকে  কুরআনের রঙে রঙীন  করার নাম হলো দারসুল কুরআন”। যেহেতু দারস তৈরির মাধ্যমে একজন কর্মীর যোগ্যতা ও দক্ষতা বহুগুনে বৃদ্ধি পায়, কুরআনের সাথে মহব্বত আর ভালবাসার এক সুনিবিড় বন্ধন তৈরি হয়, তাই ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মীকে দারসুল কুরআন তৈরির উপর সীমাহীন গুরুত্বারোপ করতে হবে, পরিকল্পনা মাফিক কুরআনের উপর মেহনত করতে হবে, প্রতিমাসে অন্তত একটি দারস যেন অবশ্যই তৈরি হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে, এভাবে দারস তৈরীর মাধ্যমে আল-কুরআনের সৈনিককে গোটা বিশ্ব মানবতার উদ্দেশ্যে কুরআনের মূল ম্যাসেজ কি? তা হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। কুরআন নিয়ে চিন্তা গবেষনা করে তার নিগুঢ় তত্ত্ব উপলব্ধি করতে হবে। কুরআনের মর্মবাণী ভালোভাবে আত্মস্থ করে নিজেদের জীবনকে কুরআনের রঙে রঙীন করতে হবে। আর মানুষকে একথা বুঝাতে হবে যে, আল-কুরআন কেবল সুন্দর দামী গেলাফ দ্বারা সুসজ্জিত করে রাখার বস্তু নয়, আবার ঘরের কোণে আলমারিতে অবহেলিত হয়ে থাকার বস্তুও নয় বরং আল-কুরআন হলো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ ও চিরন্তন মু’জিযা, বিশ্ব মানবতার মুক্তিসনদ। যে প্রজন্মের মধ্যে কুরআন সরাসরি নাযিল হয়েছিল তাদের জন্য কালজয়ী এ মহাগ্রন্থ যেমন উপযোগী ও চির আধুনিক ছিল, ঠিক তেমনিভাবে তাদের পরবর্তী আগত অনাগত সকল প্রজন্মের জন্যও আল-কুরআন চিরন্তন ও শাশ্বত জীবনাদর্শ। তবেই জাতিকে আলকুরআনের রাজ কায়েমের চেতনায় উজ্জিবীত, সীসাঢালা প্রাচিরের ন্যায় মজবুত সংঘবদ্ধ একটি জিহাদী কাফেলা উপহার দেয়া সম্ভব হবে, আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।

দারসুল কুরআন তৈরির ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়সমূহ
• কুরআনের ছোট সুরা বা কিছু অংশ নির্বাচন করা।
• যদি নির্দিষ্ট শানে নুযুল থাকে তাহলে তা বর্নণা করা। আর যদি নির্দিষ্ট শানে নুযুল না থাকে তাহলে সম্ভব হলে শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. এর তাফসীরের মুলনীতি সম্পর্কে লিখিত গ্রন্থ “আল ফাওযুল কাবীর” থেকে প্রতিটি আয়াতের মৌলিক শানে নুযুল জেনে নেয়া।
• ফযীলত থাকলে তা বর্নণা করা।
• বিষয়বস্তু বের করা।
• সরল অনুবাদ করা।
• কোন কঠিন শব্দ থাকলে সেই কঠিন শব্দের শাব্দিক বিশ্লেষণ বর্ণনা করা।
• সুরা বা আয়াত সংশ্লিষ্ট সংক্ষিপ্ত ব্যখ্যা বর্ণনা করা।
• সুরা বা আয়াত থেকে অর্জিত শিক্ষা পয়েন্ট আকারে নোট করা।
আয়াত মুখস্ত করণ:  কথার মজবুতি ও গ্রহনযোগ্যতার জন্য রেফারেন্স জরুরী। কুরআন হাদীসের রেফারেন্স দিয়ে কথা বললে মানুষ সেটা সহজেই গ্রহণ করে। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণ বিষয় ভিত্তিক আয়াত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীর মুখস্ত থাকতে হবে। এ ছাড়া ঈমানের পরে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত হলো নামায। এই নামায যথাযথভাবে আদায় করার জন্যও কুরআনের কিছু অংশ মুখস্ত থাকতে হয়। তাই পরিকল্পনার আলোকে কুরআন মুখস্ত করতে হবে।

শেয়ার করুন

আরো পড়ুন

যোগদিন আমাদের সাথে

ইসলামের মূল তিন কাজ- তা’লীমে দ্বীন (দ্বীনের শিক্ষা), তাবলীগে দ্বীন (দ্বীনের দাওয়াত) ও তাগলীবে দ্বীন (দ্বীনের বিজয়) এর সমন্বয়ে ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য পাঁচ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ১. দাওয়াত, ২. সংগঠন, ৩. প্রশিক্ষণ, ৪. সমাজকল্যাণ, ৫. আন্দোলন। আমি বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস ঘোষিত কর্মসূচির সাথে একাত্মতা পোষণ করছি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এ সংগঠনে যোগদান করছি।

Scroll to Top