কারাগারকে বাহির থেকে যতটা ভয়ংকর মনে হয় ভিতরে তা না: মাওলানা শরীফ হুসাইন

মাওলানা শরীফ হুসাইন। একজন অন্তপ্রাণ মানবদরদী আলেম। খেলাফত ছাত্র মজলিসের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের অন্যতম। বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের কেন্দ্রীয় সমাজ কল্যাণ বিভাগের সম্পাদক। মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হকসহ সকল মজলুম আলেমের মুক্তি আন্দোলন কন্দ্রীক এক্টিভিটির কারণে ঘুরে এওসেছেন নববী পাঠশালা থেকে। তাঁর সাথে এক সুন্দর সকালে আলাপ হয় স্মারক প্রতিনিধিদের সাথে। মনোমুগ্ধকর সেই আলাপচারিতা পাঠকদের সামনে তুলে ধরছেন মুহাম্মাদ আব্দুল আজিজ ও মানসুরুল হাসান ইয়াসিন। -সম্পাদক

স্মারক: আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ
মাওলানা শরীফ হুসাইন: ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহ
স্মারক: শুরুতেই জানতে চাই কারাবন্দীদের মুক্তির জন্য তৎপরতা কেমন ছিল ?
মাওলানা শরীফ হুসাইন: আমরা আগেই একটা আইনজীবী প্যানেল তৈরি করে রেখেছিলাম এবং ওকালতনামায় সম্ভাব্য ব্যক্তিদের স্বাক্ষর নিয়ে রেখেছিলাম। যেন গ্রেফতার হওয়ার সাথে সাথেই আইনি শুরু করা যায়। যখন গ্রেফতার শুরু হল, তখন যেই গ্রেফতার হয়েছে আমরা তাদের নাম, বয়স, ঠিকানা, অভিভাবকের মোবাইল নাম্বার ইত্যাদি সংগ্রহ করেছি। তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছি এবং আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছি। সে সময়গুলোতে আদালতপাড়ায় যাওয়াও নিরাপদ ছিল না। তাই স্বশরীরে উপস্থিত না হয়ে আমাদের আইনজীবী প্যানেলের কাছে বার্তা পাঠাতাম, আমাদের এই নামে একজন গ্রেফতার হয়েছে অমুক থানা থেকে। আদালতের প্রাথমিক বাকি কার্যক্রমগুলো আমাদের আইনজীবীরাই করতেন। বন্দীদের মুক্তির জন্য আমরা আদালতের তদবিরগুলোও করতে থাকি আবার প্রশাসনের তদবিরও করতে থাকি। সরকারের আস্থাভাজনদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকি। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের সাধ্যে যতটুকু ছিল আমরা তার সব কিছু দিয়ে চেষ্টা করেছি । যতটুকু পেরেছি আল্লাহর এহসানে পেরেছি। যতটুকু পারি নাই নিজেদের দুর্বলতার কারণে পারি নাই।


স্মারক: আপনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল যখন অন্যান্য মুক্তি পেয়ে যাচ্ছিলেন। এবং খুব হঠাৎ করে গ্রেফতার হয়েছিলেন। আমরা শুরুতে বিশ্বাসও করতে পারিনি ব্যাপারটা। প্রশ্ন হল, এত পরে এত তড়িঘড়ি গ্রেফতারের কারণ কি মনে করেন?
মাওলানা শরীফ হুসাইন: তখন মাওলানা মামুনুল হকসহ সবার মুক্তির জন্য গণস্বাক্ষর আন্দলোন চলতেছিল সারা দেশে। সেই তৎপরতায় আমার অংশগ্রহণটা ছিল অত্যন্ত জোরাল। মনে হয়, এ কারণে আমি বন্দী হয়েছি। ২৬ মার্চ জুমাবার বাইতুল মোকাররম এলাকায় একটি মারামারি হয়েছিলো। ওই মামলায় এজহারনামি ৯ জন, এবং বেনামি ২০০০ থেকে ২৫০০ জন আসামি ছিল। পুলিশ আমাকে এ মামলার অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে বন্দী দেখায়।
স্মারক: রিমান্ড হয়েছিল ? অভিজ্ঞতা কেমন ?
মাওলানা শরীফ হুসাইন: আমার রিমান্ড হয়ে ছিল একদিনের। রিমান্ডে আমাকে কোন আঘাত করে নাই, মৌখিক জিজ্ঞা করেছে। সম্ভবত তিন চার বার জিজ্ঞেসাবাদ করেছিল। আমি স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিয়েছি। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আমার পরিবারের সদস্যরা আমার সাথে সাক্ষাৎ করেছে। আমাকে এরেস্ট করার পরপরই তারা আমার পরিবারের সবার মোবাইলে আঁড়ি পাতে। তার কার সাথে কী বলেছে তা সংগ্রহ করে। এ ভিত্তিতে রিমান্ডে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনার পরিবার তো বলতেছে, আপনার মোবাইলে নাকি অনেক কিছু আছে? উত্তরে আমি তাদের বললাম, আমার মোবাইল তো আপনাদের কাছেই আছে । আমার মোবাইলে যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা আপনারাই বের করতে পারেন। আমি চ্যালেঞ্জ করেছি, আমার মোবাইলে এমন কিছু নেই যেটা আইন বিরোধী। আমি স্বচ্ছ রাজনীতি করি এবং রাজনীতির স্বচ্ছ ধারণা আমার আছে।
রিমান্ডের গারদে সবাই মোটামুটি পানির বোতল মাথার নিচে দিয়ে ঘুমায়। আলাদা কোন ব্যবস্থা নেই। কম্বল দু-একটা আছে এগুলো যারা ওইখানে দীর্ঘদিন ধরে থাকে তারাই দখল করে রাখে। সেখানে যাদের সাথে ছিলাম তাদের অনেকেই মাও. মামুনুল হক সাহেব, সংগঠন, এবং আমাদেরকে ভালোবাসে। সেই হিসেবে রিমান্ডের এক রাত আমার খুব বেশি কষ্ট হয়নি।
স্মারক: হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল ভিতরে? হলে কেমন সময় কেটেছে?
মাওলানা শরীফ হুসাইন: আদালত জামিন নামঞ্জুর করার পর পুলিশ আমাকে কেরানীগঞ্জ পাঠিয়ে দিল। কেননা, ঢাকা জেলার সমস্ত আসামীকে প্রথমে গ্রহণ করে ঢাকা কেরানীগঞ্জ কারাগার। পরে সেখান থেকেই কাশিমপুর বা বিভিন্ন জায়গায় পাঠায়। আমি প্রায় দেড় মাস কেরানীগঞ্জে ছিলাম। যেহেতু হুজুর আগের থেকেই কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন সেহেতু বন্দী হওয়ার দেড় মাস পর্যন্ত হুজুরের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় নাই। বের হওয়ার ৫ দিন আগে আমাকে কাশিমপুরে পাঠানো হয়। কাশিমপুরের হাই সিকিউরিটিতে ঢোকার পরপরই আমদানিতে আমার কাছে হুজুর লোক পাঠিয়েছিলেন। কোন কিছু লাগবে কিনা, কোন অসুবিধা আছে কিনা? এগুলো জানতে চাইলেন। শনিবার দিন আমদানিতে থাকলাম। রবিবার দিন সকালবেলা জায়গা ঠিক করার জন্য যখন কেইস টেবিলে নিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো তখন কেইস টেবিলে থাকা অবস্থাতেই মাও. মামুনুল হক সাহেব আমার আমার কাছে আসেন। ওই সময়ই হুজুরের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় । হুজুর কেইস টেবিলে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি উদ্বিগ্ন হয়ো না। তোমাকে আমার সাথেই নিচ্ছি। আমরা একসাথে থাকবো। ওইখানে যে সিনিয়র জমাদার আছে তাকে তিনি বলে গেলেন, মাওলানা শরীফ কে আমার সাথে দিতে হবে। শরীফ এবং ফয়সাল আমার লোক। আমিও বলছি আমাকে ওখানে দিতে হবে। যেহেতু আমি হেফাজতের লোক সেহেতু আমাকে তাঁর সাথে দিতে হবে অন্য কোথাও আমি যাব না। ইতোমধ্যে আরেকজন বন্দী গোল্ডেন মনির, তিনিও আবার আমাদেরকে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করলেন। শেষ পর্যন্ত, হুজুর যে বিল্ডিংয়ের ৬ তালায় ছিলেন আমাদেরকে ওই বিল্ডিং এর তিন তলায় নিয়ে যাওয়া হলো। মনির সাহেবের কামরা এখানে। ওখানে ঢোকার পরপর আমরা তো শুধু রাত্রিবেলা আমাদের কামরায় ঘুমিয়েছি। আর সারাদিন ওই ছয় তলায় গিয়ে হুজুরের সাথেই থাকতাম। খাওয়া-দাওয়া, নামাজ, কথাবার্তা সবই ছয় তলায় হতো। আমি অনেক সময় উপরে না গেলে হুজুর নিজেই আসতেন উপর থেকে, এসে আমাদেরকে নিয়ে যেতেন। এরপরে বাকি সময় সাখাওয়াত রাজি, মাও. মামুনুল হক সাহেব, ফখরুল ভাই, মাও. আমির হামজা সাহেব আমরা সবাই একসাথেই ছিলাম। এভাবেই আমার দিনের লম্বা সময় হুজুরের সাথে কেটেছে। বের হওয়ার সময়ও তো হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করে, কথাবার্তা বলে, হুজুরকে জড়িয়ে ধরে, হুজুর কান্নাকাটি করে বের হয়েছি।

স্মারক: কারাগারের সামগ্রিক হালত?
মাওলানা শরীফ হুসাইন: কারাগারকে বাহির থেকে যতটা ভয়ংকর মনে হয় ভিতরে তা না। শীতকালে গোসল করার মতো কিছুটা। কোনভাবেই কারাগারের গেটের ভিতরে ঢুকে গেলে কারাগারের ভীতিটা কেটে যায়। কারাগারটাকে নিজের ঘর বানিয়ে নিতে হয়। কারাগারেটাকে কেউ যদি কারাগার মনে করে তাহলে তার জন্য কষ্টকর। আর যদি মনে করে, এটাই আমার ঘর। এখানেই থাকতে হবে কিছুদিন। এভাবেই থাকতে হবে। তাহলে তার জন্য তুলনামূলক কষ্ট কম হয়। কেরানীগঞ্জে একটা কেন্দ্রীয় কারা মক্তব আছে। লাইব্রেরীর মত বড় একটা কক্ষ। যারা নামাজ পড়তে চায়, তেলাওয়াত করতে চায়, বই-পুস্তক পড়তে চায়, ইসলামী পরিবেশে থাকতে চায় তারা ওই কক্ষে সারাদিন থাকতে পারে। পড়াশোনা করতে পারে । তেলাওয়াত শুদ্ধ করতে চাইলে তেলাওয়াত শুদ্ধ করতে পারে। আজান শিখতে চাইলে আজান শিখতে পারে। বন্দীদের ভিতরে যারা ধর্মীয় জ্ঞান রাখে, তারা ওইখানে অন্যদের শিক্ষা দেয় । আবার যারা খারাপ মানুষ, যারা মাদকাসক্ত তাদের একটা বলয় আছে।
আমার হাতের ডান পাশে যে শুতো সে ছিল যুবদলের। আর আমার বামে যে ছিল সে ছিল যুবলীগের। আবার তার পাশে যে ছিল সে ছিল হিন্দু। আবার আমার পিছন দিকে যে ছিল সে ছিল হিজবুত তাহরীরের। কিন্তু আমরা সবাই একসাথেই থেকেছি, কখনোই আমাদের ভিতরে ঝগড়া হয় নাই।
কেরানীগঞ্জে দিনের বেলা বের হওয়ার সুযোগ আছে যার যার ওয়ার্ড থেকে। লকাপ থাকে না, তো আমি সারাদিন মোটামুটি বাহিরেই থাকতাম বাহিরে বিভিন্ন জনের সাথে কথাবার্তা বলা হাঁটাচলা করতাম। বিকেল পাঁচটা থেকে নিয়ে সকাল পাঁচটা পর্যন্ত ছয়টা পর্যন্ত তো লকআপ করা থাকে। ওখানে সুন্দর একটা পরিবেশ ছিল, ওখানে কিছু দ্বীনি ভাই ছিল আমরা মসোয়ারা করছিলাম যে, আমরা দিনের একটা সময়, বিশেষ করে আছর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সবাই চুপচাপ থাকবো। তেলাওয়াত জিকির আজগার যে যা পারে সেটা করব। এই সময় কেউ কোনো রকম আওয়াজ করতে পারবে না, যার মনে চায় সে চুপচাপ শুয়ে থাকবে অথবা বই-পুস্তক পড়বে অথবা অন্য কিছু করবে। কিন্তু অন্যের ডিস্টার্ব হয় এমন কোন কিছু করা যাবে না। আমার ওয়ার্ডে আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত যার যার আমল করেছে, এবং মাগরিবের বেশ পর পর্যন্ত ওখানে একটা আমলের পরিবেশ ছিল। আমলের পরিবেশের ভিতরে ওখানে কেটেছে। জেলখানায় যাওয়ার পরে ওয়ার্ডের ভিতর আমার হেফজ খানার সময় গুলো খুব মনে পড়েছে। ওখানে এত ঘুম, রাত ৯ টার ভিতর তো ঘুমাতেই হয় আটটার সময় খাওয়ার পরে তো আর কোন কাজ নেই। কতক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়। আমরা মোটামুটি ৯ টার ভিতরে সবাই ঘুমিয়ে পড়তাম। সেই হিসাবে মোটামুটি তিনটার সময় সবাই সজাগ হয়ে যেত। আমাদের যে ওয়ার্ড ছিল, আমাদের ওয়ার্ডের ভিতরে মোটামুটি আমরা সব মিলিয়ে বিশজন থেকেছি । ২০ জনের ভিতরে দেখা গেছে যে শেষ রাত্রে প্রায় ১৫ জনই শেষ রাত্রে উঠে তাহাজ্জুতের নামাজ কোরআন তেলাওয়াত করতেছে তারা কান্নাকাটি করতেছে। বয়স্ক মানুষ দেখা গেছে কান্নাকাটি করতেছে ।

বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিসের পক্ষ থেকে মুক্তি পরবর্তি সংবর্ধনা

স্মারক: মুক্তি প্রক্রিয়া কিভাবে হল?
মাওলানা শরীফ হুসাইন: মুক্তি পাওয়ার প্রক্রিয়া তো একটাই, সেটা হলো জামিন নিয়ে বের হতে হবে। এখানে তো অস্পষ্টতার কিছু নেই। সম্ভবত অক্টোবরের ২৪ তারিখ জজকোর্টে শুনানি হয়েছে এবং সেখান থেকে আমার জামিন হয়েছে। আমার কাছে সংবাদটা আসছে হল ২৫ তারিখ সম্ভবত।
সকালবেলা ফজরের পর আমরা ঘুমিয়েছি। নয়টার দিকে আমার মাথার এখানে এসে হুজুর আমাকে ডাক দিলেন। বলছে এই শরিফ ওঠো, তোমার তো জামিন হয়েছে। পরেই ওইখানে জামিন তল্লাশিতে আমাকে ডাকলো। আপনি আপনার জিনিসপত্র নিয়ে রেডি হন বের হতে হবে । আমি জেলগেটে আসলাম । পৌনে একটার সময় আমি বের হতে পারি।
স্মারক: কারাগারে যাওয়ার আগের জীবন বোধের সাথে কারাগার পরবর্তী জীবনবোথে কোন পার্থক্য এসেছে? আসলে কেমন?
মাওলানা শরীফ হুসাইন: স্বাভাবিক কারাগারের আগের জীবন কারাগারের পরের জীবন এবং কারাগারের জীবন এই তিন জীবনকে মূল্যায়ন করলে অবশ্যই পরিবর্তন আসার কথা। সেই হিসেবে মানুষ হিসেবে আমার ভিতরেও পরিবর্তন এসেছে। এখানে এসে অনেক কিছু শিখার আছে। নিজেকে শুধরানোর বড় একটি জায়গা এই কারাগার।

 

1 thought on “কারাগারকে বাহির থেকে যতটা ভয়ংকর মনে হয় ভিতরে তা না: মাওলানা শরীফ হুসাইন”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top
Scroll to Top