রিমান্ডের বিভীষিকাময় নির্যাতনের কথা ভাবলে কার না গা শিউরে উঠে। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে এক ভয়ানক দৃশ্য। যার বাস্তব বিবরণ কেবলমাত্র সেই দিতে পারে যে কিনা নিজে এর সম্মুখীন হয়েছে। অন্যথায় রিমান্ডের কালো বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। আজ আমরা অসহায় একেবারে নিরপরাধ পাঁচজন মজলুম বান্দা এক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সম্মুখীন হতে যাচ্ছি। আগামীকাল শুক্রবার ও পরের দিন শনিবার এই দুইদিন আমাদের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। সেদিন ইফতার ও মাগরিবের নামায আদায়ের পর আমরা পাঁচজন পরস্পরে আলাপ আলোচনা করছিলাম। আগামী দুদিন কি নাজানি আচরণ হয় আমাদের সাথে! এই দুইদিন থানার রিমান্ডের যে দৃশ্য চোখে পড়েছে তার খানিকটা বিবরণ এরূপ। আমাদের পাশের রুম থেকে একজন করে ডেকে নেয়া হচ্ছে। তাদের ওপর কৃত সীমাহীন নির্যাতনের আওয়াজ আমরা নিজ কানে শুনতে পাচ্ছি। কেউ আহ আহ বলে চিৎকার করছে, আবার কেউ ওমাগো বলে আর্ত-চিৎকার করছে।পাশের রুমে থাকা একজনের নাম হচ্ছে শাব্বির। তার বাসা কেরানীগঞ্জ মডেল থানার আশপাশেই। মার্ডার মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেখেছি তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যেত। ঘন্টা দুয়েক পর আবার ফেরত দিয়ে যেত। তখন দেখা যেত সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। শরীরে আঘাতের চিহ্ন হয়ে গেছে। একদিন ইন্সপেক্টর আব্দুল্লাহ সাহেব আমাদের সাথে কথা বলার সময় তাকে লক্ষ্য করে বললেন, তোর ভাগ্য ভালো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ভদ্র একজন পুলিশের ভাগ্যে পড়েছিস। আমার দায়িত্বে পড়লে তোকে গরম ডিম থেরাপি দিতাম। অবশ্য আমাদের পাঁচজনের রিমান্ড ছিল একটু অন্যরকম। আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এই দু’দিনে কোনো সময় ডাকা হয়নি; বরং সময়ে সময়ে আমাদের মামলা লেখার দায়িত্বে নিয়োজিত ইন্সপেক্টর আব্দুল্লাহ আমাদের কাছে আসত এবং খোশগল্প করত। মিষ্টি মিষ্টি আলাপের আড়ালে আমাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতো। প্রথমে আমরা তারে ধুনন্ধপনা বুঝতে পারিনি এবং এটা জানতাম না যে সে আমাদের মামলা লেখার দায়িত্বে নিয়োজিত। পরে অবশ্য একদিন সেন্ট্রি পুলিশের কাছ থেকে জেনেছিলাম যে, আমাদের মামলা লেখার দায়িত্ব তার উপর। যার ফলে আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা সতর্ক হয়ে গিয়েছিলাম; কিন্তু তারপরও সে আমাদেরকে সন্ত্রাসবিরোধী জঙ্গি মামলা দিয়েছিল। যে কারণে জেলখানায় দিনের-পর-দিন মাসের-পর-মাস আমাদেরকে বন্দীদের জীবন কাটাতে হয়েছে। রিমান্ডের বিভীষিকাময় জুলুম নির্যাতনের কাহিনী যখন লিখছি, তখন অনেক বন্দি ভাইয়ের রিমান্ডে জুলুম নির্যাতনের কাহিনী শুনতে পেরেছি যে, তাদের উপর কি পরিমাণ জুলুম নির্যাতন করা হয়েছে।
আমরা যে ভবনে রয়েছি তার এক নং ওয়ার্ডে থাকেন আনসারুল ইসলামের /আল-কায়েদার মামলা খাওয়া আব্দুল কাদের ভাই, তিনি এক বছর গুম ছিলেন। এমনিভাবে আদদাওলাতুল ইসলামিয়া বা আই এস এর মামলা খাওয়া ইয়াসিন ভাই, তাকে চার বছর গুম করে রাখা হয়েছিল। প্রিয় পাঠক আপনি চিন্তা করুন, এই দীর্ঘ সময়ে তাদের উপর কি পরিমান জুলুম নির্যাতন করা হয়েছে। আমার পাশের সিটে থাকেন আবুল কালাম ভাই, তিনি জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল মিঞা গোলাম পরওয়ার সাহেবের পি এস। তার বর্ণনা অনুযায়ী তার উপর কৃত জুলুম নির্যাতনের চিত্র ছিল এরূপ, তিনি ৬ই সেপ্টেম্বর ২০২১ইং রোজ সোমবার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে গ্রেফতার হন। সেদিন রাতে তাকে ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তারপরদিন কোর্টে হাজির করে পুলিশ দশ দিনের রিমান্ড চান, বিজ্ঞ আদালত ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। আবুল কালাম ভাইসহ নয়জনকে রিমান্ডের জন্য ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। তার রিমান্ডের বর্ণনা শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। প্রথমে গাড়ি থেকে নামিয়ে হাতে হ্যান্ডকাফ মাথায় কালো টুপি পরানো হয় এবং ডিবির ওসি সাহেবের রুমে তাকে ও ড্রাইভার মনিরকে নিয়ে যাওয়া হয়। এডিসি জিজ্ঞাসাবাদের নামে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং শারীরিক নির্যাতন করে হ্যান্ডকাফ ও কালো টুপি পড়া অবস্থায় এক অন্ধকার কুঠুরিতে ফেলে রাখে। তিন-চার ঘন্টা পর পুনরায় দুজনকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সাথে অসহনীয় কারেন্ট শট দেয়া হয়। যার যন্ত্রণা সইতে না পেরে বেহুঁশ হয়ে পরে। হুশ ফিরে আসলে আবার অনুরূপ আচরণ করা হয়। এভাবে বারংবার তাদের দুজনের সাথে এরূপ আচরণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় হাজতখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এর পরবর্তী দুদিন সিআইডি, এস বি, এন এস আইসহ প্রায় দশটি সংস্থা সকাল, দুপুর, রাত ও বিভিন্ন সময়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক নির্যাতন করতে থাকে। চতুর্থদিন ডিপিডিসি পুনরায় তার রুমে ডেকে নেয় এবং ওয়ান সিক্সটি ফোর বা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ার জন্য বাধ্য করে, মিথ্যা জবানবন্দি দিতে রাজি না হওয়াতে পুনরায় শারীরিক নির্যাতন শুরু করে এবং হ্যান্ডকাপ ও কালো টুপি পরানো অবস্থায় পুনরায় কারেন্ট শক ও লাঠি দিয়ে পেটানো শুরু করে। যার ফলে তারা দু’জন জবাই করা মুরগির মত ছটফট করতে থাকে। এভাবে সারারাত তাদের ওপর জুলুম নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হয়। অবশেষে তারা ১৬৪ ধারায় মিথ্যা সাজানো বানোয়াট জবানবন্দি দিতে বাধ্য হয়। যদি তারা বিচারকের সামনে এ মিথ্যা বানোয়াট জবানবন্দি না দিতো, তাহলে পুনরায় দু’দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে একই ধরনের শাস্তি দিত বলে হুমকি দেয়। আবুল কালাম ভাই জামিনে বের হওয়ার পর জানতে পেরেছিলাম যে, মেডিকেল চেকাপের পর ধরা পরেছে, রিমান্ডে ভয়াবহ নির্যাতনের ফলে তার কানের পর্দা ফেটে গেছে।
* কারাগারে লিখা ডায়রি থেকে *