মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে
আল্লাহ রব্বুল আলামীন মানুষকে যে সকল মৌলিক কাজগুলো দিয়ে প্রেরণ করেছেন এবং মানুষ সৃষ্টির পেছনে যে সকল মৌলিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে, তার মধ্যে মূল বিষয় হলো মানুষ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের গুণগান গাইবে। আল্লাহ পাকের প্রশংসা করবে। আল্লাহ পাকের রূবিবিয়্যাত ও বড়ত্বের সামনে নিজেকে বিলীন ও সমর্পণ করে দেবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, وَ مَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ اإِلَّ لِيَعْبُدُون
আমি জিন এবং মানবজাতিকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে । (সূরা জারিয়াত, আয়াত-৫৬)
যার দুনিয়ার সবার সাথে সম্পর্ক আছে; কিন্তু আল্লাহর সাথে সম্পর্ক নেই, তার জীবনের ষোল আনাই বৃথা। সেই সাথে মানবজীবনের লক্ষ্য এটাও যে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন যে দ্বীন দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, আল্লাহর সেই দ্বীনকে দুনিয়াতে বিজয়ী করবে। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সেই দ্বীনকে সে গালেব করবে। এটাও মূলত আল্লাহ রব্বল আলামীনের সাথে বান্দার যে মোহাব্বত ও ভালোবাসার সম্পর্ক, তার দাবি।
মোহাব্বাতের দাবী: দ্বীন বিজয়ের সংগ্রাম
মানুষের সাথে আল্লাহর যে সম্পর্ক, সেখানে মানুষ আল্লাহকে মোহাব্বত করবে। ভালোবাসবে এবং তার মনের মধ্যে আল্লাহর চেয়ে আর কারো ভালোবাসা বেশি হবে না; বরং সকলের চেয়ে আল্লাহর মোহাব্বত এবং ভালোবাসা মানুষের অন্তরে বেশি হবে।
যখনই মানুষের অন্তরে আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনের মোহাব্বত আর ভালোবাসা সবচেয়ে বেশি হবে তখন তার অনিবার্য দাবি হলো, সে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় কামনা করবে। আমি যাকে ভালোবাসি, আমি যাকে মোহাব্বত করি তার অসম্মানকে কখনোই সহ্য করবো না, বরদাশত করবো না; বরং আমি চাইবো সর্বত্র তাঁর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক। কাজেই আমরা যখন আমাদের যিন্দেগীর মাকসাদ বানাবো আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সাথে সম্পর্ক করা, আল্লাহর সাথে মোহাব্বত তৈরি করা এবং যখন এটা আমাদের যিন্দেগীর প্রথম টার্গেট হিসেবে নির্ধারণ করলাম; তখন অনিবার্যভাবেই এ কথাটা সামনে চলে আসে যে, আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দ্বীনের অসম্মান, অমর্যাদা, হেয় করাকে কখনোই বরদাশত করবো না। সহ্য করবো না। আমরা বলতে পারি, আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা ইনসানী যিন্দেগীর মৌলিক মাকসাদ, মানুষের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
একটি প্রশ্ন
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, একদিকে বলা হলো আল্লাহর ইবাদত করা, মানুষের যিন্দেগীর উদ্দেশ্য। আবার বলা হচ্ছে, আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা হলো মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য! আসলে মানুষের যিন্দেগীর উদ্দেশ্য কোনটা? প্রশ্নের জবাব পরিষ্কার । এখানে একটার সাথে আরেকটার কোনো বৈপরীত্য নেই; বরং উভয়টার সারকথা- উভয়টার ফলাফল- সেই একই জায়গায় গিয়ে মিলিত হয়। আমি যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে মোহাব্বত করবো। ভালোবাসবো। তো আল্লাহর প্রতি আমার মোহাব্বাত এবং ভালোবাসার অনিবার্য পরিণাম হবে, আমি আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় দেখতে চাইবো। যদি আমি আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় নাই দেখতে চাই, তাহলে আমার এই মোহাব্বত আর ভালোবাসার কোনো অর্থ হলো?
মনে করুন আমি আপনাকে বললাম, ভাই! আপনাকে আমি খুব মোহাব্বত করি! অথচ বাস্তবে আপনাকে অপমান করতেছি, আপনার প্রিয় সন্তানকে আমি অসম্মান করতেছি, লাঞ্চিত করতেছি, আপনার মা বাবাকে হেয় করতেছি; অথচ মুখে মুখে আমি দাবি করতেছি, ভাই! আমি আপনাকে খুব মুহাব্বত করি। এই কথাটা যেমন অবাস্তব, তেমনি অবান্তর এই কথা বলা, আমি আল্লাহকে ভালোবাসি; কিন্তু তাঁর দ্বীনের বিজয়ের কামনা করি না। এ জন্য চূড়ান্ত পরিণামে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় কামনা করা, আল্লাহর দ্বীনের বিজয় চাওয়া, আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার চেষ্টা করাকে ইনসানী যিন্দেগীর বা মানব জীবনের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বলা যেতে পারে।
আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হওয়ার জন্য আমরা যারা আল্লাহর মোহাব্বতের পাত্র আছি, আমাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের সৈনিক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা যদি আল্লাহর দ্বীনের সৈনিক হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারি, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের দ্বারা তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন। এটা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের আদত ও নীতি। আল্লাহর দ্বীনের সৈনিক হিসেবে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা এমনিতেই হবে না। কারণ, এখানে আরেকটা প্রতিপক্ষ আছে। সেই প্রতিপক্ষের সার্বক্ষণিক চিন্তা-ভাবনা ও সাধনাÑ কীভাবে আল্লাহর দ্বীনকে উৎখাত করা যায়। বিষয়টি এমন নয় যে, এই পৃথিবীতে আমরা শুধু একাই পক্ষ, যারা আল্লাহকে ভালোবাসি। যারা চাই আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী হোক। কোনো প্রতিপক্ষ নেই। কোনো শত্রুপক্ষ নেই!
শত্রুপক্ষ
মানব জাতীর সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই ভিন্ন আরেকটা পক্ষ দাঁড়িয়েছে। যে পক্ষ সেই প্রথম দিনই দাম্ভিকতার সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে বলেছিলো,
ثُمَّ لاتينهم من بين ايديهم ومن خلفهم و عَن أَيْمَانِهِمْ وَ عَن شمائلهم : وَ لا تَجِدُ اكثرهم شكرين
তরজমা : তারপর আমি তাদের উপর হামলা করব, তাদের সামনে দিয়ে, তাদের পেছন দিয়ে, তাদের ডান দিয়ে, তাদের বাম দিয়েও। তুমি তাদের অধিকাংশকেই শোকর আদায়কারী হিসেবে পাবে না। (সূরা আরাফ, আয়াত-১৭)
শয়তান চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করে দিয়েছে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন যখন আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালামকে দুনিয়াতে প্রেরণ করলেন, তখনও আল্লাহ পাক তাদেরকে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন,
قَالَ اهْبِطَا مِنْهَا جَمِيعًا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ فَإِمَّا يَأْتِيَتُكُمْ مني هُدًى : فَمَن اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَ لَا يَشْقَى তরজমা : আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা দু’জনে (আদম ও ইবলীস) একই সঙ্গে নিচে নেমে যাও, তোমরা একে অপরের শত্রু। অতঃপর আমার নিকট থেকে তোমাদের কাছে সঠিক পথের নির্দেশ আসবে, তখন যে আমার পথ নির্দেশ অনুসরণ করবে, সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং কষ্টেও পতিত হবে না। (সূরা ত্বহা, আয়াত-১২৩)
ভিন্ন জায়গায় আল্লাহ পাক এভাবে বলেছেন,
إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٍ
তরজমা: নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৬৮) অর্থাৎ, তোমরা দুনিয়াতে যাও। দুনিয়াতে তোমাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বসবাসের সুযোগ থাকবে। তবে মনে রেখো, দুনিয়াতে প্রতিটি মুহূর্তে তোমাদের জন্য এক মহাশত্রুও থাকবে। সে হলো ইবলিস। লাআনাতুল্লাহি আলাইহি। তারা চায়, জমিনে আল্লাহর দ্বীন শুধু পরাজিত নয়, বরং জমিন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাক। আল্লাহর জমিন থেকে আল্লাহর দ্বীন নাস্তানাবুদ হয়ে যাক। কারা চায়? যারা চায় তাদেরকে বলা হয় ‘শয়তান’।
শয়তান দুই প্রকার
কুরআন মাজিদের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ রব্বুল আলামীন এই শয়তানের ক্লাসিফিকেশন ও তাদের প্রকারভেদ বর্ণনা করেছেন,
من شر الوسواس الخناس الذي يوسوس في صدور الناس من الجِنَّةِ وَ النَّاس
তরজমা : (আশ্রয় প্রার্থনা করছি) আত্মগোপনকারী কু-মন্ত্রণাদাতার অনিষ্টতা হতে, যে মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দেয়। জিনের মধ্য হতে অথবা মানুষের মধ্য হতে। (সূরা নাস, আয়াত ৪-৬)
মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দিয়ে মানুষকে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ের পথ থেকে বিপথগামী করে যে ভিন্ন পথে পরিচালিত করে, সে হলো খান্নাস। আর সেই খান্নাসের হলো দুই শ্রেণী। একটা হলো জিন শ্রেণী। আরেকটা মানুষ শ্রেণী। অর্থাৎ শয়তান দুই প্রকার। জিন শয়তান এবং মানব শয়তান।
এভাবে বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ রব্বুল আলামীন পৃথিবীতে দুইটা পক্ষ সাব্যস্ত করেছেন এবং দুইটা পক্ষের নামও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। দুইটা জায়গায় আল্লাহ পাক দুই পক্ষের নাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এক পক্ষ সম্পর্কে বলেছেন,
أولئك حزب الله ، أَلا إِنَّ حِزْبَ اللَّهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
তরজমা : এরাই আল্লাহর দল। জেনে রেখ, আল্লাহর দলই সাফল্যমণ্ডিত] (সূরা মুজাদালা, আয়াত-২২)
আবার এর বিপরীতে আল্লাহ বলে দিয়েছেন,
أولئك حزب الشيطان ، ألا إن حِزْبَ الشيطان هُمُ الْمُفْلِحُونَ
তরজমা: এরাই শয়তানের দল। জেনে রেখ, শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত। (সূরা মুজাদালা, ১৯)
দ্বীপাক্ষিক সংঘাত। দল দুটি। পক্ষ দুটি। এক পক্ষে আমরা চাই, আমাদের যিন্দেগীর মাকসাদকে হাসিল করার জন্য আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করতে। আরেক পক্ষ চায়, সর্বশক্তি দিয়ে আল্লাহর দ্বীনকে দুনিয়া থেকে উৎখাত করতে। পরাজিত করতে। এখানে অনিবার্যভাবে পক্ষ দুটি হলো, আর এই দুই পক্ষের মধ্যে বিপরীতমুখী চাহিদা পাওয়া গেল, তখন এই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতটা অনিবার্য হয়ে দাড়ালো। সংঘাত অনিবার্য। এখানে আমি বা আপনি চাইলেও সংঘাত এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। যখন আমি চাই আল্লাহর দ্বীনের বিজয় তখন অপর পক্ষ আল্লাহর দ্বীনের পরাজয় চায়।
চাই শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার
আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দ্বীনের এই বিজয়ের জন্য সংঘাত যখন অনিবার্য, তো এই সংঘাতের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার জন্য কিছু আসবাবের প্রয়োজন। প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করার জন্য কিছু শক্তির প্রয়োজন। কারণ, যেখানেই দুই পক্ষ, সেখানেই সংঘাত। যেখানেই সংঘাত, সেখানেই শক্তির প্রয়োজন হয়। বিপক্ষ দলের উপর বিজয় অর্জন করার জন্য কিছু আসবাব এবং কিছু অস্ত্রের প্রয়োজন হয়; কিছু হাতিয়ারের প্রয়োজন হয়; কিছু শক্তি আর সামর্থ্যের প্রয়োজন হয়; আল্লাহ রব্বুল আলামীন দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য তাঁর বান্দাদের হাতেও এরকম একটা শক্তি তুলে দিয়েছেন, যেই শক্তির মাধ্যমে আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর দ্বীনের প্রতিপক্ষ ও শত্রুদেরকে পরাজিত করতে পারে। ধরাশায়ী করতে পারে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেই শক্তি আমাদেরকে দিয়েছেন। যেই শক্তির মাধ্যমে আমাদেরকে শয়তানী অপশক্তির মোকাবেলা করার জন্য তাওফীক দিবেন; সেই শক্তিটা কী? সেটা দুনিয়ার কোন বাহ্যিক এবং জাহিরি শক্তি নয়। দুনিয়ার শুধু অস্ত্র আর জনবলের শক্তি নয়। আল্লাহ রব্বুল আলামীন ঈমানদারদেরকে যেই শক্তির মাধ্যমে ইবলিসি শক্তির মোকাবিলায় সফলতা দান করেন; বিজয় আর কামিয়াবী দান করেন; সেই শক্তির নাম হলো, রূহানীয়াতের শক্তি। রূহানীয়াতের শক্তিটাই হলো হকের পথে মুমিনের প্রধান সম্বল এবং প্রধান হাতিয়ার। হ্যাঁ! দুনিয়ার বাহ্যিক আসবাব, জাহেরি শক্তিও ঈমানদাররা ব্যবহার করবে। এটাও ঈমানদারদের হাতে থাকবে; তবে ইসলামের ইতিহাসে দ্ব্যর্থহীনভাবে এই কথা প্রমাণিত যে, রূহানীয়াতের এই শক্তি, এটাই হলো ঈমানদারদের আসল শক্তি। এই শক্তিতে যখন মুমিনরা বলিয়ান হয় তখন জাহেরি শক্তি আর দুনিয়ার হাতিয়ারের শক্তি কিছুটা কাজে আসে। আল্লাহ না করুন, ঈমানদাররা যদি রূহানী শক্তি থেকে সম্পূর্ণ রূপে বঞ্চিত হয়, তাহলে ওই সামান্য জাহিরি শক্তি আর হাতিয়ারের শক্তি তাদের জন্য কোন উপকারে আসবে না।
যেরকম আপনার হাতে খুব শক্তিশালি পিস্তল আছে, এটা দিয়ে খুব পাওয়ারফুল গুলি ছুড়া যায়, গুলি কারো গায়ে বিদ্ধ হলে তার বাঁচার উপায় নাই। তবে আপনার হাতের আঙ্গুল নাই, যেই আঙুল দিয়ে আপনি বন্দুক বা পিস্তলের ট্রিগার চাপ দিবেন। অথবা আপনার হাত নাই, যেই হাত দিয়ে আপনি বন্দুক ধরবেন। এখন আপনার কাছে যদি পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান বন্দুকও থাকে, সবচেয়ে শক্তিশালী পিস্তলও যদি আপনার হাতে থাকে, তাহলে আপনার সেই পিস্তল কোনো কাজেই আসবে না। ঠিক এরকম, ঈমানদাররা ঈমানী পথে শত্রুদেরকে পরাজিত করার জন্য ঈমানদারদের যে বুনিয়াদী শক্তি, যেই শক্তির উপর ভিত্তি করে তারা দুনিয়ার জাহেরি শক্তি ও অস্ত্রের শক্তিকে ব্যবহার করতে পারে, মুমিনের জন্য সেই শক্তির নাম হলো রূহানীয়াতের শক্তি। যেমন, একজন হাত কাটা মানুষের কাছে ধারালো তরবারি থাকলেও শত্রুর জন্য সেই তরবারি কোনো ক্ষতির কারণ হবে না। ওই তরবারি যদি আপনার গলায় ঝুলন্ত থাকে তো ওই তরবারি দেখে শত্রুর কিছুই হবে না; বরং উল্টো এটা হতে পারে, শত্রু আপনার গলা থেকে সেই তরবারি নিয়ে আপনাকেই বধ করবে। তাই, ঈমানদাররা দুনিয়াতে যদি তাদের প্রতিপক্ষ শক্তিকে পরাজিত করতে চায় তাহলে তাদের শক্তির বুনিয়াদ হলো রূহানীয়াতের শক্তি। এই রূহানীয়াতের শক্তি উপরই মুমিনের জাহিরী শক্তি ও অস্ত্রের শক্তির বুনিয়াদ কায়েম হয়। রূহানী শক্তিটা হলো মুমিনের হাতের মতো। সেই জাহিরী শক্তি হলো সেই হাতে ধারণকৃত তরবারির মতো।
আবার বলছি, রুহানী শক্তি হলো মুমিনের হাতের মতো। আর জাহিরী শক্তি ও অস্ত্রের শক্তি হলো সেই হাতের মধ্যে ধারণকৃত তরবারির মতো। এখন আপনার যদি হাত না থাকে, তাহলে যতই ধারালো তরবারি থাকুক না কেন, যতই উন্নত মানের তরবারি থাকুক না কেন, সেই তরবারি আপনার লড়াইয়ে কোনো কাজে দিবে না; বরং ক্ষেত্রবিশেষে সেই তরবারিই আপনার শত্রুর হাতিয়ার হয়ে আপনার দিকে উদ্ধত হতে পারে এবং আপনার পতন ঘটতে পারে। এই জন্য আরবিতে একটা প্রবাদ আছে,
السيف بالسَّاعِد لا السَّاعِد بالسيف
তরজমা : তরবারী হাতের জন্য, হাত তরবারীর জন্য নয় ।
দুনিয়াতে তরবারি কথা বলে হাতের শক্তিতে। হাত কখনো তরবারির শক্তিতে কথা বলে না। তরবারিতে কতটুকু শক্তি আছে? সেটা নির্ধারণ হবে তরবারির পেছনে যেই হাত তরবারীকে ধারণ করে আছে সেই হাত কীভাবে তরবারিকে পরিচালনা করতে চায়। কীভাবে পরিচালনা করতে পারে। সেই হাতের মধ্যে কতটুকু ক্ষমতা আছে, এটার উপরে বুনিয়াদ হলো তরবারির শক্তির।
পরাশক্তির বিরুদ্ধে রূহানীশক্তির গর্জন
হযরতে রিবয়ী ইবনে আমের রা.। আল্লাহর পয়গাম্বরের সাহাবী। যখন পারস্যের সাথে মুসলমানদের লড়াই হলো, পারস্য সেনাপতি মুসলিম সেনাপতিকে বলেছিলো, তোমরা আমাদের দেশে এসেছো, পারস্য দেশে লড়াই করার জন্য, যুদ্ধ করার জন্য। তোমরা এক কাজ করো, তোমাদের একটা লোক আমার কাছে পাঠাও। আমি তার সাথে একটু আলোচনা করতে চাই। মুসলিম সেনাপতি, আল্লাহর নবীর সাহাবী হযরত রিবয়ী ইবনে আমের রা. কে পাঠিয়ে ছিলেন যাও, পারস্য সেনাপতি রুস্তমের কাছে। সে আমাদের একজনের সাথে কথা বলতে চায়। তুমি আমাদের মুসলমানদের পক্ষ থেকে পারস্য সেনাপতি রুস্তমের সাথে গিয়ে কথা বলো। হযরত রিবয়ী ইবনে আমের রা. গেলেন। খুব সাধারণ মামুলি একজন মুসলমানের যেই হালাত ছিলো সেরকমই অবস্থা। একটি মামুলি ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে, সাদাসিধা তালি দেওয়া কাপড় পরিধান করে, সাধারণ একটা ঘোড়ায় আরোহন করে, সাধারণ তরবারী নিয়ে, পারস্য সেনাপতি রুস্তমের কাছে গেলেন। লম্বা ইতিহাস। প্রথমে তো তারা এই লেবাসে সেখানে ঢুকতেই দিবে না। তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, মুসলমান তাঁর আদর্শ ছাড়বে না। তোমার সেনাপতি আমাকে ডেকেছেন। এই অবস্থাতেই যদি সে কথা বলতে চায়, আমি কথা বলবো। না হয় তার সাথে আমার কথা বলার কোন আগ্রহ নাই।
পারস্য সেনাপতি ভেতরে ডাকলেন। হযরত রিবয়ী ইবনে আমের রা. ঘোড়া নিয়ে সোজা ঢুকে গেলেন পারস্য সেনাপতি রুস্তমের শাহী বালাখানায়। সেখানে গিয়ে দেখেন, ঘোড়া বাঁধার কোন জায়গা নেই। তাই হাতের তরবারি দিয়ে সেনাপতির দামী কার্পেট ছিদ্র করে তার ঘোড়ার রশি বেঁধেছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন, একজন মুসলিম সৈনিকের কাছে তোমার এই পারস্য সেনাপতির দরবারের চাকচিক্য, জৌলুশ, দামি দামি দুনিয়ার আসবাব, লাল গালিচা, মখমলের গালিচা এগুলোর কোনো মূল্যও মর্যাদাই তাদের কাছে নেই।
অনেক কথোপকথন সেখানে হয়েছিল। পারস্য সেনাপতি জিজ্ঞাসা করেছিলো, কে তোমাদেরকে পাঠিয়েছে? কেন পাঠিয়েছে? অনেক কথা। সেখানে একটা কথা এই ছিলো যে, তুমি এই সাধারণ একটা মামুলি তরবারি নিয়ে এসেছো, আর তোমরা এই ধরণের তরবারি নিয়ে স্বপ্ন দেখো পারস্য সাম্রাজ্য জয় করবে? তোমরা পারস্যের সৈনিকদের সক্ষমর্তা, পারস্যের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা, তাদের সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বুঝি তোমাদের কোনো ধারণা নেই ? এরকম ভাঙ্গাচুরা একটা তরবারী দিয়ে পৃথিবীর সুপার পাওয়ার পারস্য সাম্রাজ্যকে জয় করে ফেলবে ? এই বুঝি তোমাদের ধারণা? হযরত রিবয়ী ইবনে আমের রা. পারস্য সেনাপতিকে বলেছিলেন, হে পারস্য সেনাপতি রুস্তম মুসলমানের মামুলি তরবারি দেখছো, কিন্তু এই তরবারি মুসলমান যেই হাতে ধারণ করে লড়াই করে, সেই হাতের শক্তি তুমি পরীক্ষা করে দেখনি। তুমি তো শুধু তরবারি দেখেছো, কিন্তু এই তরবারীর পেছনে যে বাহু, সে বাহুর শক্তি দেখোনি। তুমি যদি চাও তাহলে আমার এই বাহুর শক্তি পরীক্ষা করে দেখতে পারো, একজন মুমিনের বাহুতে কী পরিমাণ শক্তি আছে!
হযরত রিবয়ী রা. বলেছিল, তুমি তোমার শক্তিশালী ঢালটাকে দিয়ে আমার এই মামুলি তরবারির আক্রমণ মোকাবেলা করে দেখো। পরীক্ষা করে দেখো, আমার তরবারির মধ্যে শক্তি কী পরিমাণ আছে। সবচেয়ে শক্তিশালী ঢালটাকে দিয়ে পারস্য সেনাপতি তার একজন চৌকস সেনা কর্মকর্তাকে মাঠে নামিয়ে দিলো যে, দেখি, মুসলিম সৈনিকের এই ভাঙাচোরা তরবারির মধ্যে কী পরিমাণ শক্তি আছে!
ইতিহাস লেখে, রিবয়ী ইবনে আমের রা. পারস্য সেনাপতির দরবারে মামুলি তরবারি দিয়ে যখন আঘাত করেছিলেন, এক আঘাতের পর দ্বিতীয় আঘাতের প্রয়োজন পড়েনি! পারস্য সেনাপতির দম্ভ আর অহংকার, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। তরবারির মামুলি একটা আঘাতে। এটা তো তরবারির শক্তি না, এটাতো বাহুর শক্তি ছিলো। আসলে মুমিন বুঝে, মূলত এই শক্তিটা বাহুরও না, বরং এই শক্তি বাহুটা যেই বক্ষে ধারণ করা সেই বুকের ভিতরের। বুকের ভিতর থেকেই সেই শক্তি বাহুতে আসে। বাহুর সেই শক্তিটা প্রকাশ পায় তরবারির মাধ্যমে।
আসলে তো শক্তি তরবারিতেও নয়, শক্তি বাহুতেও নয়। মুমিনের প্রকৃত শক্তির পাওয়ার হাউজের মূল উৎস হলো তার বুকের ভিতর। তার বক্ষে সেই শক্তি উৎপাদন হয় এবং সেই শক্তিটাই কার্যকর হয় তার হাতের তরবারির মাধ্যমে। ইতিহাস সে কথাই বলে। রোম সাম্রাজ্য যখন মুসলমানদের কাছে পদানত হয়েছিলো, হযরতে ওমর ফারুক রা. এর খেলাফতকালে । গোটা রোমান সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে গেয়েছিলো সাধারণ কিছু মুসলমান সৈনিকদের সামনে। বিশাল সাম্রাজ্য ভেঙ্গেচুরে তসনস হয়ে গেছে। তাসের ঘরের মতো লুটিয়ে পড়েছে। রোম সম্রাট তার সৈনিকদের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলো, তোমরা খাটি মুসলমানদের কাছে মার খেয়ে পালাও কেনো, কী এমন শক্তি ওদের কাছে আছে, তোমাদের কাছে যেটা নেই, অথচ তোমরা পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় শক্তি!
সবচেয়ে বড় সৈন্যবাহিনী তোমাদের, সৈনিকরা সবচেয়ে বেশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, বিশ্বসেরা সব হাতিয়ারসহ সব কিছু তোমাদের কাছে। তোমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে মজবুত, তোমাদের প্রত্যেকের গায়ে লোহার বর্ম, সব ঠিক আছে। তোমাদের যে বাহন, পৃথিবীর সেরা সেরা ঘোড়াগুলো। সেই ঘোড়ার পিঠে সাওয়ার হয়ে, সবচেয়ে শক্তিশালী লৌহবর্ম পরিধান করে, সবচেয়ে শক্তিমান তরবারিগুলো হাতে নিয়ে, সবচেয়ে চৌকস প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী, সর্বাধিক সংখক সেনা নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হও। আর ওই আরবের মামুলি বেদুইন, যাদের কোন প্রশিক্ষণ নাই। তাদের সাধারণ সাধারণ তরবারির আঘাত খেয়ে তোমরা এমনভাবে ময়দান থেকে পালিয়ে আসো, সব তছনছ হয়ে যায়। রাজ্যের পর রাজ্য মুসলমানদের করতলগত হয়ে যায়। তোমরা জবাব দাও কোন শক্তির অভাব তোমাদের কাছে আছে, আর মুসলমানরা এমন কোন শক্তিতে বলীয়ান, যেই শক্তি তাদেরকে আজ অপরাজেয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত করেছে ? তখন একটা জবাব এসেছিলো, একজন রোম সৈনিকের মুখ থেকে। সে বলেছিলো, জাহাপনা মুসলমানদের মধ্যে দুটি জিনিসের শক্তির সমন্বয় হয়। সেই সমন্বয় উৎস হলো
لنهار ا وفرسان اليل رهبان هم
তারা দুটো জিনিসের সমন্বয় ঘটায়। তাদের সমন্বয়টা কী? সমন্বয়টা হলো, তারা রাতগুলোতে হয় সময়ের দুনিয়াত্যাগি। দুনিয়াবিরাগী। আল্লাহওয়ালা । রাতের বেলায় তারা থাকে দুনিয়াবিরাগী সন্ন্যাসীদের মতো। দুনিয়া বিরাগী সন্ন্যাসী যেরকম দুনিয়ার সাথে কোন তাআল্লুক নাই। কোন সম্পর্ক নেই। ঠিক এরকম। যাদেরকে রাহেব বলা হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে যুগে এরকম দুনিয়াবিরাগী এক শ্রেণীর মানুষ পয়দা হয়েছে ইসলামের মধ্যে। যারা আল্লাহর দ্বীনের সৈনিক। তাদের রাতের কিছু প্রহরে, রাতের একটা সময়ে তারা এরকম হয় যে, দুনিয়ার সাথে তাঁদের কোন সম্পর্ক নেই। তারা এক আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দরবারে দন্ডায়মান হয়। আল্লাহর দরবারে জায়নামাজে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। চোখের অশ্রুতে বুক ভাসায়। এ হলো তাদের রাতের বেলার পরিচয়। রাতের অন্ধকারে যাদের চোখের অশ্রুতে বুক ভেসেছিলো, রাতের নিস্তব্ধ নিরবতায় যাদের বুক ফাটা কান্নার আহাজারীতে খোদার আরশ পর্যন্ত কপে উঠেছিলো। দিনের বেলায় তারা কান্না কী জিনিস ভুলে যায়। রাতের বেলায় যাদের চোখে অশ্রু গড়ায়, দিনের বেলায় তাদের চোখ থেকে জ্বলন্ত বারুদ বের হয়। ওরা যখন শত্রুদের দিকে অগ্রসর হয়ে যায়, তখন তাদের মানসিকতা কী থাকে? তাদের মানসিকতা থাকে এই, আমরা আমাদের জীবনকে রক্ষা করার জন্য যতটা পাগল থাকি, ওরা আল্লাহর জন্য জীবন দিতে তার চেয়ে বেশি পাগল থাকে। আমরা জীবনে বেঁচে থাকাটাকে নিজের জীবনে সফলতা মনে করি। আর তারা আল্লাহর জন্য জীবন দেওয়ার মধ্যেই নিজেদের স্বার্থকতা খুঁজে পায়।
শাহাদাতের তামান্না
কেমন পাগল আর উন্মাদ তাঁরা হয়ে যেতেন। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা.-এর ইতিহাস পাওয়া যায়। তিনি বলেন, জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে তিনি যুদ্ধ থেকে যুদ্ধে, রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ঘুরে বেড়াতেন। শাহাদাতের তামান্না বুকের মধ্যে এমনভাবে বাসা বেঁধেছিলো, তিনি শুধু শহীদ হওয়ার জন্যই যুদ্ধ করতেন। একটা পর্যায়ে গিয়ে যখন দেখলেন, শহীদ হওয়া যাচ্ছে না, সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। তখন আর কোন লোহার বর্ম পরিধান করতেন না। লোহার টুপি পরতেন না। খালি হাতে তরবারি নিয়ে শত্রুপক্ষের মোকাবিলা করতেন। যাতে শত্রুর আঘাত লাগে আর শাহাদাতের মৃত্যু নসিব হয়। কিন্তু আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকে উপাধি দিয়েছেন “সাইফুল্লাহ” তথা আল্লাহর তরবারি। এই তরবারি যদি কাফেরদের শহীদ হয়ে যায় তাহলে তো আল্লাহর তরবারিটা ভেঙে গেলো। এজন্য আল্লাহ রব্বুল আলামিন উনার তাকদীরে শাহাদাত রাখেননি। উনি তো শহীদ হওয়ার জন্য একরকম পাগল হয়ে রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ছুটতে থাকতেন। লোহার কোন বর্ম নেই। মাথায় কোন লোহার টুপি নেই। মামুলি তরবারি নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে লক্ষ লক্ষ কাফেরদের সঙ্গে লড়াই করেছেন। বীর বিক্রমে শত্রু পক্ষের বুহ্য ভেদ করে, কাতারগুলো ভেদ করে শত্রুদের বাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়তেন। আবার তাদেরকে কচুকাটা করে পেছনে ফিরে আসতেন। শত্রুরা কেউ হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. কে পরাস্ত করতে পারে নাই। এই ভাবে চলতে চলতে এক সময় জিহাদের ময়দানে তিনি অক্ষম হয়ে পড়লেন। তিনি বিছানায় অসুস্থ অবস্থায় কাতরাতে কাতরাতে যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তখন দুনিয়ার মানুষকে ডেকে ডেকে বললেন,
فها أنذا أموتُ على فراشي فلا نامت أعين الجبنا
হে দুনিয়ার ভীরু কাপুরুষের দল! যারা মনে করো আল্লাহর জন্য জিহাদের ময়দানে গেলেই বুঝি মরতে হবে। মরণের ভয়ে যারা ঘরের মধ্যে বসে থাকো, দেখো! আমি খালেদকে দেখে তোমরা শিক্ষাগ্রহণ করো। আমি মৃত্যুকে সন্ধান করতে পৃথিবীতে হাজারে পর হাজার মাইল ছুটে বেরিয়েছি। শুধুমাত্র মৃত্যুকে খুঁজেছি যুদ্ধের ময়দানে, কোথায় কোন জিহাদে গেলে আমি মৃত্যুকে খুঁজে পাবো; কিন্তু আমি খুঁজে পাইনি। আমি যেখানে গিয়েছি মরণ আমাকে দেখে পালিয়েছে। আর এখন সাধারণ বিছানায় ছটফট করতে করতে আমার মৃত্যু হচ্ছে। যুদ্ধের ময়দানে আমি মরণকে খুঁজে পাইনি। আমাকে বিছানায় এসে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হচ্ছে; সুতরাং হে দুনিয়ার ভিরু কাপুরুষের দল, তোমাদের চোখের শীতলতা নষ্ট হয়ে যাক! তোমরা যারা মনে করো যে, আল্লাহর জন্য সংগ্রামের ময়দানে, জিহাদের ময়দানে নামলেই বুঝি মরতে হবে আর ঘরের মধ্যে বসে থাকলে বুঝি মরণ আসবে না! তোমরা আমাকে দেখে শিক্ষা নাও যে, আমি জিহাদের ময়দানে মৃত্যুকে খুঁজে পাইনি বরং বিছানায় এসেই আমাকে মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গন করতে হচ্ছে।
প্রয়োজন দুই বৈশিষ্ঠের সমন্বয়
কেমন ছিলো তাদের প্রেরণা! মৃত্যুর সন্ধান। সেই রোম সৈনিক, তার উচ্চপদস্থ সম্রাটকে বললো, আমাদের মধ্যে আর মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্যের বুনিয়াদ হলো এই জায়গায় لنهار ا وفرسان اليل رهبان هم তারা রাতের বেলায় তাহাজ্জুদগুজার। রাতে তারা চোখের অশ্রু ঝরায়। সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। চোখের পানিতে আল্লাহর জমিনকে ভেজায়। আর দিনের বেলায় তাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরে না; বরং যেই জমিন রাতের অন্ধকারে তাদের অশ্রুতে সিক্ত হয়েছে, সেই জমিন দিনের বেলায় সিক্ত হয় তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে। তাদের তাজা খুনে আল্লাহর এই জমিন রঞ্জিত হয়। এই ভাবে তারা দুটো জিনিসের সমন্বয় ঘটায়। হে রোম শক্তি! যত দিন পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে এই শক্তি থাকবে। তাদের রাতের বেলা রুহানিয়াত থাকবে আর দিনের বেলা ফুরসানিয়্যাত থাকবে। যতদিন তারা রাতের বেলায় তাহাজ্জুদগুজার থাকবে আর দিনের বেলায় বীর মুজাহিদ হবে, ততদিন পর্যন্ত এই মুসলিম বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুখে দেওয়ার সাধ্য পৃথিবীর কোন শক্তির হবে না। সত্যিকার অর্থেই মুসলমান যতদিন পর্যন্ত এই দুই বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় ধরে রেখেছিলো, পৃথিবীর কোন শক্তিই মুসলমানদের অস্ত্র অভিযান রুখে দিতে পারেনি।
মোটকথা, আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার পেছনে একজন মুমিনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো, রূহানীয়াতের শক্তি। এজন্যই আল্লাহ রব্বুল আলামীন যখন হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এই মিশন দিয়ে দুনিয়াতে পাঠালেন, আপনি আল্লাহর দ্বীনেকে দুনিয়াতে ছড়িয়ে দিন। প্রথমে দাওয়াত দিন। তারপর আস্তে আস্তে এই দ্বীনকে বিজয়ী করবেন। আল্লাহপাক রব্বুল আলামীন তাঁর রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রথমেই শক্তি সঞ্চয় করার একটা পদ্ধতি আল্লাহ বলে দিলেন, কী ভাবে আপনি শক্তি সঞ্চয় করবেন, যে শক্তির মাধ্যমে আপনি আপনার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করবেন।
بليها الأمزمل (۱) قيم اليل إلا قليلا (۲) نصفه او انقص منه قليلا (۳) او زِدْ عَلَيْهِ و رَتِّلِ الْقُرْآنَ تَرْتِيلا (٤) إِنَّا سنلقي عليك قولا ثقيلا (۵) ان ناشئة اليل هى أشد وطأ و أقوم قيلا (٦) إن لك في النَّهَارِ سَبْحًا طويلًا (۷)
তরজমা : হে বস্ত্রাবৃত! রাতে সালাতে দাঁড়ান, কিছু অংশ ছাড়া। আধা-রাত বা তার চেয়েও কম। অথবা তার চেয়েও একটু বেশি। আর কুরআন তিলাওয়াত করুন ধীরে ধীরে সুস্পষ্টভাবে। আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। নিশ্চয় রাত জাগরণ আত্মসংযমের জন্য অধিকতর প্রবল এবং স্পষ্ট বলার জন্য অধিকতর উপযোগী। (সূরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ১-৭)
আল্লাহ বলে দিলেন যে, রাতের সময়গুলোকে কাজে লাগান। রাতের সময়কে কাজে লাগান।
قم اليل إلا قليلا
রাতের সময়টা আপনি দাঁড়িয়ে থেকে কিয়ামুল লাইলের মাধ্যমে অতিক্রম করুন। ঘুমাতে হলে সামান্য কিছু সময় ঘুমান। আর বাকি রাত দাড়িয়ে থেকে আপনি অতিক্রম করুন। কেনো রাত দাঁড়িয়ে থেকে আমি অতিক্রম করবো কেনো রাতে আমি অল্প ঘুমাবো ? আল্লাহ আকবার, আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন সে কথাটাই বলেছেন
ان ناشنة اليل هي اشد وطا و القوم قيلا
রাতের বেলায় আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করার দ্বারা আপনার অন্তরের মধ্যে অনেক শক্তি সঞ্চার হবে।
انَّ لَكَ فِي النَّهَارِ سَبْحًا طويل
ও নবী! আপনাকে তো দিনের বেলায় বহু দূর পথ চলতে হবে, এজন্য আপনাকে রাতের বেলায় শক্তি সঞ্চার করতে হবে।
কথাটা কী সুন্দর! আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনের হিসাবটা কী ? আর আমাদের হিসাব কী? আমরা কিভাবে বিবেচনা করি ? আমরা সাধারণত বিবেচনা করি এই ভাবে, দিনের বেলায় অনেক কাজ; সুতরাং রাতের বেলায় অনেক বেশি ঘুমাতে হবে। আর আল্লাহ কী বলেছেন যে, দিনের বেলায় তোমার অনেক কাজ, এই জন্য রাতের বেলায় তোমার অনেক বেশি দাঁড়াতে হবে। হ্যাঁ কত পার্থক্যা إن لك فِي النَّهَارِ سَبْحًا طويلا যে দিনের বেলায় অনেক পথ চলতে হবে। সাধারণ পথ নয়, দূর্গম পথ আপনাকে পাড়ি দিতে হবে। পানির উপর দিয়ে সাঁতার কেটে সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে। পায়ে হেটে জমিন অতিক্রম করার চেয়েও পানির উপর দিয়ে পথ অতিক্রম করা অনেক বেশি কঠিন।
আল্লাহ বলছেন, আপনাকে যে পথ অতিক্রম করতে হবে এটা পায়ে হেঁটে মাটির উপর দিয়ে পথ অতিক্রম করা নয় বরং এটা হলো পানির মতো তরল পথ দিয়ে সাঁতার কেটে পথ অতিক্রম করার মতো কঠিন পথ। তাহলে আপনি এই কঠিন পথ পাড়ি দিবেন কীভাবে? এই কঠিন পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য আপনাকে অফুরন্ত শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। আর অফুরন্ত সেই শক্তি এটা ঘুমিয়ে সঞ্চিত হয় না। অফুরন্ত সেই শক্তি সঞ্চিত হবে রাতের বেলায় কিয়ামুল লাইলের মাধ্যমে। রাতের বেলায় আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে থাকার মাধ্যমে।
রণাঙ্গনের প্রধান হাতিয়ার
এই যে রাতের বেলার শক্তি, এটাই হলো মুসলমানদের দিনের বেলার রণাঙ্গনের প্রধান হাতিয়ার। আপনি যদি দিনের বেলায় অনেক বেশি পথ চলতে চান তাহলে রাতের বেলায় সেই অনুযায়ী আপনাকে প্রস্তুতি নিতে হয়। এখন তো আমরা দৃষ্টান্ত দেই খুব সহজ। আপনার মোবাইল ফোন আছে। দিনের বেলায় আপনাকে অনেক কথা বলতে হবে। মোবাইল অনেক ব্যবহার করতে হবে। সারা দিনের জন্য আপনি ঘর থেকে বের হয়ে যাবেন। আবার সন্ধ্যায় ফিরবেন। রাস্তাঘাটে চার্জ দেওয়ার কোন সুযোগ থাকবে না। তাহলে তার করণীয় কী? সারা রাত মোবাইল চার্জ থেকে খুলে রাখা?
রাতে তাকে ফুল চার্জ দিয়ে রাখতে হবে। রাতের বেলায় যদি আপনার ব্যাটারির চার্জ ফুল করে রাখেন। তাহলে আপনি দিনের বেলায় পূর্ণাঙ্গ ভাবে এই মোবাইল দিয়ে উপকৃত হতে পারবেন। আর যদি রাতে আপনার চার্জ কম হয় তাহলে দেখা যাবে দিনের বেলায় দুই ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা কথা বলার পর আপনার মোবাইল চুপচাপ করে বন্ধ হয়ে যাবে। তখন কেউ আপনাকে ফোন দিতে পারবে না। জরুরি কথা আপনি কাউকে বলতেও পারবেন না। তো যেরকম দিনের বেলার মোবাইলে কথা বলতে হলে রাতের বেলায় চার্জ দিয়ে চার্জ ফুল করে রাখতে হয়। ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহর দ্বীনের পথে যারা লড়াই করতে চায়। আল্লাহর দ্বীনের পথে যারা দূর্গম পথ পাড়ি দিতে চায়। আল্লাহর দীনের পথে যারা সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অপর প্রান্তে দীনের ঝান্ডা সমুন্নত করতে চায়, তাদের জন্য আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সাজেশন এবং আল্লাহর হেদায়াত ও নির্দেশনা হলো,রাতের বেলায় ব্যাটারী চার্জ দিয়ে রাখো!
কিয়ামুল্লাইল
রাতের বেলার এই ব্যাটারি চার্জ, এই রূহানীয়াতের চার্জ, এটা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হয় না; বরং রাতের বেলার এই রূহানীয়াতের চার্জ এটা আল্লাহ রববুল আলামীনের দরবারে কিয়ামুল লাইলের মাধ্যমে, সেজদায় লুটিয়ে পড়ে চোখের অশ্রু ঝড়ানোর মাধ্যমে হয়। এ জন্য দ্বীনকে বিজয়ী করবার কাজটা, বিশেষ করে আপনার বিপক্ষে যখন এত এতো শত্রুবাহিনী। আপনার বিপক্ষে যখন এতো বড় বড় প্রতিপক্ষ শয়তান। শয়তানের দোসর। সমস্ত শক্তিগুলো যখন সর্বশক্তি দিয়ে আপনাকে রুখে দিতে চায়। আপনার পথ রুদ্ধ করে দিতে চায়। আপনার অগ্রাভিযানকে বাঁধাগ্রস্থ করতে চায়। বিঘ্ন তৈরি করতে চায়। তখন আপনার আর আমার কাজ হলো, শত্রু যেমন অনেক বড় প্রস্তুতিও নিতে হবে অনেক বেশি। আর আমার প্রস্তুতির সেই মূল সূত্রটি হলো আমাকে রূহানীয়াতের শক্তিতে বলিয়ান হতে হবে। রূহানীয়াতের এই শক্তির প্রধান উৎসটাই হলো কিয়ামুল লাইল। তথা রাতের গভীরে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সাথে মোহাব্বাত আর প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করা। আর আরেকটা হলো
و اذكر اسم رَبِّكَ وَ تَبَل إِلَيْهِ تُبْتِيلا
তরজমা : আর আপনি আপনার রবের নাম স্মরণ করুন এবং তার প্রতি মগ্ন হোন একনিষ্ঠভাবে (৮)।
জিকরুল্লাহ
আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে নিজের মনের ভেতরে শক্তি সঞ্চয় হয়। আল্লাহর সাথে পরিপূর্ণ কানেকশন ও নিবিড় সম্পর্ক হয় জিকরুল্লাহর মাধ্যমে। আর আল্লাহর জিকিরের মধ্যে সর্ব শ্রেষ্ঠ জিকির
افضل الذِّكْرِ تلاوة القُرْآن
أَفضَلُ الذِّكْرِ لَخَالَةَ إِلَّا الله
দুই রকমই এসেছে : ১. ‘লা ইলাহ ইল্লাল্লাহ’ ২. ‘তিলাওয়াতে কুরআন’ সর্বশ্রেষ্ঠ জিকির। সুতরাং আমাদের পথের সকল প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে যেই শক্তির প্রয়োজন, সেই শক্তি পাবো কোথায়? এক. সেই শক্তি আসে জিকরুল্লাহর মাধ্যমে। দুই. সেই শক্তি আসে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে। আর সবচেয়ে বেশি শক্তি আসে রাতের অন্ধকারে আল্লাহর দরবারে তাহাজ্জুদের জায়নামাজে দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াত আর সেজদায় লুটিয়ে পড়ে চোখের অশ্রু ঝরানোর মাধ্যমে। এগুলোর মাধ্যমে আমাদের শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। আর এই শক্তিটা আমরা যত বেশি সঞ্চয় করবো, আমাদের দিনের বেলায় প্রত্যেকটা কাজ তত বেশি ইফেক্টিভ, ও শক্তিশালী হবে। আমাদের দাওয়াত তত বেশি শক্তিশালী হবে রাতের বেলায় আমার জিকিরের পাওয়ার যত বেশি থাকবে। আমার দাওয়াত তত বেশি ইফেক্টিভ হবে রাতের বেলায় আমার তিলাওয়াতে কুরআন আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে যতো নিবিড়ভাবে পেশ হবে। কাজেই, ব্যাটারিত পাওয়ার যে পরিমাণ থাকে, টর্চের আলো সেই পরিমাণ হবে। আস্তে আস্তে পাওয়ার কমে আসলে টর্চ লাইট আছে, সব আছেÑ সুইচ টিপবেন, দেখবেন আলো জ্বলবে না। জ্বললেও একটুখানি গিয়ে কিছুই দেখা যায় না; অথচ এটা সেই টর্চ লাইট যেই টর্চ লাইট দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। কিসের পার্থক্য? টর্চ লাইট তার আপন জায়গায় আছে। টর্চের যে বার তার আপন জায়গায় আছে। সব ঠিক আছে কিন্তু ব্যাটারির মধ্যে পাওয়ার নাই। আবার চার্জ দেন। এক ঘণ্টা দুই ঘন্টা তিন ঘন্টা চার্জ দেন। এর পরে আবার টিপ দেন, দেখবেন সেই টর্চ লাইট আগের মতো আপনার চারিদিক ফকফকা আলো উপহার দিবে।
রূহানিয়াতের শক্তি
আমাদের দিনের বেলার দাওয়াত তত বেশি কার্যকর হবে, রাতের বেলায় আমাদের রূহানীয়াতের শক্তি যত বেশি রিচার্জ হবে। আপনি করে দেখুন। রাতের বেলায় তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে, আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে পরের দিনের জন্য আল্লাহর কাছে তাওফীক কামনা করেন, আল্লাহ! আগামীকাল আমাদের ইজতেমায়ী দাওয়াত আছে। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের এই ইজতেমায়ী দাওয়াতকে কামিয়াবী দান করুন। এই ইজতেমায়ী দাওয়াতের মাধ্যমে ভাইকে দ্বীনের পথে আনার তাওফিক দান করুন। এভাবে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে যখন আপনি দাওয়াতের মাঠে যাবেন। আপনার সে দাওয়াত হবে অনেক বেশি পাওয়ারফুল। আর আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে বলা নাই, কওয়া নাই, তাহাজ্জুদের আমল নাই, জিকির নাই, আল্লাহর কাছ থেকে তাওফিকের কামনা নাই, চোখের অশ্রু ছেড়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে শক্তি প্রার্থনা করা নাই, আপনি মনে করতেছেন, আমি তো এমনিতে অনেক সুন্দর কথা বলতে পারি, মানুষের কাছে গিয়ে সুন্দর কথা বলতে পারবেন। মুখের কথা কানের মধ্যে পৌঁছবে কিন্তু হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছবে না।
আমরা যদি চাই, আমাদের দাওয়াত ইফেক্টিভ হোক, দাওয়াত পাওয়ারফুল হোক, আমার দাওয়াত শক্তিমান হোক, দাওয়াতের শক্তি শুধু মুখের কথা দিয়ে হয় না। দাওয়াতের শক্তি শুধু যুক্তি দিয়ে হয় না। দাওয়াতের শক্তি শুধু সুন্দর বক্তব্য দিয়ে হয় না। দাওয়াতের আসল শক্তি সঞ্চার হয় রূহানীয়াতের দ্বারা। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে, দুআ করে, তাওফীক চেয়ে আপনি যে দাওয়াতী প্রোগ্রাম করবেন- ইনশাআল্লাহ! সে দাওয়াতী প্রোগ্রামের রঙ এবং তার নূর ভিন্ন হবে। ঠিক তদ্রুপ আপনি যখন বাতিলের মোকাবেলায় প্রতিবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করবেন। আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের জন্য মাঠে নামবেন। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর পয়গাম্বরের ইজ্জতের ঝান্ডা সমুন্নত করতে চাইবেন। এই সকল বিষয় নিয়ে আমরা মাঠে নামার পরে সেই প্রোগ্রামের প্রভাব দেশের উপর, জাতির উপর, প্রতিপক্ষের উপর, কতটুকু প্রভাব ফেলবে সেটা নির্ভর করে আমরা এই প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করার আগে রুহানীয়াতের পাওয়ার কী পরিমাণে হাসিল করেছি। যেই পরিমাণ বেটারির চার্জ হাসিল হবে লাইটের আলোর পাওয়ার সেই পরিমাণ ছড়াবে।
জুহদ ও জিহাদ
এ দুটো একটা আরেকটার পরিপূরক। একটা আরেকটার সাথে সমন্বিত। জুহদ এবং জিহাদের এই সমন্বয়, রূহবানীয়াত আর ফুরসানিয়াতের যে সমন্বয়, রাতের বেলার তাহাজ্জুদগুজার আর দিনের বেলার শাহ সাওয়ার, এ দুটোর সমন্বয় মুসলমানদেরকে বিশ্বব্যাপী অপরাজেয় বাহিনীতে পরিণত করেছে। আমরা যদি চাই, আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে দিয়ে তার দ্বীনের বড় খেদমত নিয়ে নিক। আমাদের দ্বারা দ্বীনের দাওয়াত সম্প্রসারিত হোক। আল্লাহর দ্বীনের ঝান্ডা সমুন্নত হোক। আমরা যদি চাই আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের এই কঠিন এবং দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় হিমালয়ের এভারেস্টের চূড়ায় আল্লাহর দীনের ঝান্ডা সমুন্নত করবো। এই যদি হয় আমাদের হিম্মত। এই যদি হয় আমাদের মাকসাদ। আর এই যদি হয় আমাদের যিন্দেগীর লক্ষ্য এবং টার্গেট। তাহলে আমাদেরকে এই জুহুদের মাধ্যমে, মুজাহাদার মাধ্যমে, আমলের মাধ্যমে, তাকওয়া এবং ত্বহারাতের মাধ্যমে, জিকরুল্লাহ আর তিলাওয়াতের মাধ্যমে, তাহাজ্জুদ আর কিয়ামুল লাইলের মাধ্যমে, কান্না আর রোনাজারির মাধ্যমে আমাদের মূল শক্তিটা ক্রয় করতে হবে।
ঢাল নাই, তরবারি নাই, নিধিরাম সর্দার!
নিধিরাম সর্দাররা যেরকম ঢাল তরবারি ছাড়া লড়াই করতে পারে না। যুদ্ধ করতে পারে না। সে রকম কান্নাকাটি, তিলাওয়াত আর জিকির ছাড়া আমাদের দ্বীনি কাজের মধ্যে কোন পাওয়ার আর প্রাণ থাকবে না। এ জন্য এবিষয়ের উপর আমরা খুব গুরুত্ব দেই। ব্যক্তিগত জিন্দেগীতে আমরা সবাই এর উপর খুব মেহনত করি। সবাই খুব মেহনত করবেন। আমাদের যে কাজের মধ্যে যে তরতীব দেওয়া হয়েছে। সেই তারতীবের ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তির রূহানীয়াতের উন্নতির জন্য নেযামুল আমালের মধ্যে সুস্পষ্ট একটা গাইডলাইন আছে। একটা রোডম্যাপ আপনার সামনে দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যেন জামাতের সাথে আদায় করা হয়। প্রতিদিন একটি নির্ধারিত পরিমাণ তিলাওয়াতে কুরাআন যেন হয় । নিয়মিত একটা সময় আল্লাহর জিকির করা চাই। অল্প হোক । ১০টা মিনিট। এতো ব্যস্ততা তো দরকার নাই। দুনিয়াতে এতো কাজ করা তো দরকার নাই যে, আমি ১০টা মিনিট আমার মালিকের জিকির করার সময় পাই না। এতো ব্যস্ত হতে কে বলছে আমাদেরকে? কার জন্য এত ব্যস্ততা? কিসের জন্য এতো ব্যস্ততা? সেই মালিককে স্মরণ করার জন্য ১০ মিনিট আমি বের করতে পারি না। কী হবে আমার এই ব্যস্ততা দিয়ে?
আমার মরহুম শায়েখ ও মুরশিদ আল্লামা আশরাফ আলী রহিমাহুল্লাহ তিনি বলতেন, প্রতিদিন অল্প সময় হলেও জিকির করা এমন যে, আপনি জিকির করতে থাকবেন। জিকির করতে থাকবেন। জিকির করতে থাকবেন। দিলটা যদি পাথরের মতোও শক্ত হয়ে থাকে, তবুও নিয়মিতভাবে একটা পাথরের উপর পানির ফোটা পড়তে পড়তে পাথরটা পর্যন্ত বিদীর্ণ হয়ে যায়। অথচ পানির চেয়ে তরল আর নরম জিনিস পৃথিবীতে নাই। পাথরের চেয়ে শক্ত জিনিসও কিছু নাই।
ভাই! নিয়মিত আল্লাহর জিকির যদি কেউ করে তাহলে তার দিল যতো কঠোর, যতো পাষাণ হোক না কেনো আল্লাহর জিকিরের দ্বারা বান্দার দিলের মধ্যে কাসাওয়াতে কালবি দূর হয়ে তার দিলের মধ্যে রূহানিয়াত পয়দা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। এই জন্য তিলাওয়াতে কুরআন। প্রত্যেক ব্যক্তি তিলাওয়াতে কুরআন করতে হবে। একটা সময় নির্ধারণ করে যার জন্য যে সময় সম্ভব সকালে হোক, বিকালে হোক, রাতে হোক, শেষ রাত্রে হোক, একটা সময় নির্ধারণ করার চেষ্টা করা চাই। সেই নির্ধারিত সময়ে ১০ মিনিট হোক বা ১৫ মিনিট হোক, নিয়মিত করে নেযামুল আমল অনুযায়ী অজিফা আদায় করা। এই অজিফা, তিলাওয়াতে কুরআন আর তিন নফল (১) সালাতুদ দোহা। (২) সালাতুল আউওয়াধীন। (৩) কিয়ামুল লাইল। এই তিন নফলের কথা বিশেষভাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরামর্শ দিয়েছেন।
واستعينوا بالغذوة والروحة وشيء من الدلجة رواه البخاري
দিনের বেলার প্রথম প্রহরে সালাতুদ দোহা। রাতে প্রথম প্রহরে সালাতুল আউওয়াবীন। রাতের শেষ প্রহরে কিয়ামুল লাইল। এই তিন নামাজের মাধ্যমে তোমরা আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীনের রহমতকে নিজেদের সাথে নিয়ে নাও। আল্লাহর রহমত শামিলে হাল হয়ে যাবে।
শেষ কথা!
কাজেই, আমরা যদি জিহাদে কামিয়াবি অর্জন করতে চাই, আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে শক্তি অর্জন করতে হবে। রণাঙ্গনে যদি সফলতা পেতে চাই, মজবুত হাতিয়ার নিয়ে মাঠে যেতে হবে। যদি আমরা বাতিলের মোকাবেলায় সফলতা আর কামিয়াবী অর্জন করতে চাই তাহলে আমাদেরকে এভাবে কিছু আমলের মাধ্যমে, কিছু জিকরুল্লাহর মাধ্যমে, কিছু তিলাওয়াতের মাধ্যমে, কিছু রোনাজারি আর কিছু অশ্রু আল্লাহর দরবারে বিসর্জন দেওয়ার মাধ্যমে সেই আধ্যাত্মিক শক্তি, রূহানীয়াতের সেই ত্বাকাত আমাদের হাসিল করতে হবে। এ বিষয়ে আমরা সেই চেষ্টা সবসময় করবো, শুধু আজকে আর কালকের জন্য নয়। শুধু ইসলাহী মজলিসের জন্যই এসকল আমল নয়। শুধু তরবিয়তী সফর আর তরবিয়তী মজলিসের সময় নয়। শুধুমাত্র তরবিয়তী ইজতেমায় নয়; বরং এটা আমাদের প্রাত্যহিক আমলে পরিণত হওয়া চাই। প্রত্যেক দায়িত্বশীল, প্রত্যেক কর্মী, প্রত্যেক জনশক্তি এইভাবে নিজের ব্যক্তিগত যিন্দেগীকে আমলের দ্বারা সমৃদ্ধ করবেন। ইনশাআল্লাহ! তাহলে আমরা যে লক্ষ্য নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছি, আল্লাহর রহমত আমাদের পরিপূর্ণ শামিলে হাল হয়ে যাবে। আল্লাহর রহমতকে সঙ্গে নিয়ে যদি আমরা সামনে অগ্রসর হতে পারি, ইনশাআল্লাহ! আমাদের একেক কদমে হাজার কদমের বরকত হবে। আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমরা যেনো আমাদেরকে এভাবেই রূহানীয়াতের শক্তিতে বলিয়ান করে আল্লাহর দ্বীনের প্রকৃত সৈনিক হিসেবে নিজেদেরকে আল্লাহর দরবারে পেশ করতে পারি। আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে তাওফীক দান করেন। আমীন।