সাংগঠনিক বয়স তার ১৫ বছরের উপরে হবে। নীরব সংগঠকসাধক। কথা কমবলা মানুষ। ইসলামী ছাত্র মজলিসের স্বর্ণালি যুগের দায়িত্বশীল। পতনযুগের একজন চাক্ষুষ সাক্ষী। ছাত্রসংগঠন করার স্বাদ বিষাদ সুখ দুঃখ সব অভিজ্ঞতা সাজিয়ে রেখেছেন জীবনের মোড়কে।
প্রিয় পাঠক- বলছিলাম বর্তমান ঢাকা মহানগরী বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের সভাপতি মাওলানা রাকিবুল ইসলাম রকিব ভাইয়ের কথা। যুব মজলিসের প্রাকজমানার একসদস্য। হয়েছিলেন খেলাফত ছাত্র মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতিও। নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। খেলাফত ছাত্র মজলিস এতোদূর আসার পিছনে যাদের ত্যাগ তিতিক্ষা কুরবানি সবচে’ বেশি, তাদের একেবারে সফফে আওয়ালে যারা রয়েছেন তাদের অন্যতম হলেন তিনি। তার ফেলে আসা সাংগঠনিক জীবন কাহিনী শুনতে মুখোমুখি হয়েছিলেন আল আবিদ শাকির ও ফয়সাল মাহমুদ। তাদের হুবহু কথামালা তুলে ধরা হলো- সম্পাদক।
আত তাগলীব : সাংগঠনিক জীবনের শুরুটা কখন?
রাকিবুল ইসলাম রকিব : ২০০১ সালে ফতোয়া বিরোধী আন্দোলনের সময় ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে বুঝতে শিখি, এবং তখন থেকে ইসলামী আন্দোলনের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। আর ২০০২ সালের শেষ দিকে ইসলামী ছাত্র মজলিসের প্রাথমিক সদস্য ফরম পূরণের মাধ্যমে সাংগঠনিক জীবন শুরু হয়।
আত তাগলীব : বড় সংগঠনের বড় পদ রেখে একটি অনিশ্চিত পথে যাত্রা শুরু করলেন। অনুপ্রেরণা কী ছিল?
রাকিবুল ইসলাম রকিব : আসলে পদ-পদবীতো আর মূল উদ্দেশ্য নয়, দ্বীন বিজয়ের কাজের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখাই মূল উদ্দেশ্য। আর তখন যে সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম সেটার মাধ্যমে নিজের মধ্যে দ্বীন বিজয়ের চেতনা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, আর আমিও এমন একটি প্লাটফর্ম খুঁজতেছিলাম যাতে দ্বীন বিজয়ের খোরাক পাই। ঠিক সেই মুহূর্তে মাওলানা মামুনুল হক সাহেব হুজুরের যুগান্তকারী উদ্যোগ বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস। যুব মজলিসের চিন্তা চেতনা আদর্শ ও বৈশিষ্ট্যগুলো আমার কাছে উপযোগী মনে হয়েছে, এজন্য শুরু থেকেই এ কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিই।
আত তাগলীব : সংগঠনের প্রথম দিকের স্মরণীয় কিছু স্মৃতি যদি বলতেন!
রাকিবুল ইসলাম রকিব : সংগঠনের প্রথম দিকের স্মরণীয় স্মৃতি বলতে ২০০৯ সালের শেষের দিকে সদস্য প্রশিক্ষণ চক্রের ১ম ক্লাস আছরের নামাযের পর নরসিংদী বানিয়াছলে আব্দুল আহাদ আনাস ভাইয়ের এক আত্মীয়ের বাসায় হয়। অপর দিকে ঐদিনই বিকাল ৩ টায় পূর্ব অবগতি ছাড়াই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের এক পক্ষের সভাপতি মাহফুজ ভাই আসে নরসিংদীতে। কারণ ছিলো ওইদিনই জেলা কমিটি করা, কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বৈঠকে বসি, কিন্তু আসরের সময় ঘনিয়ে আসায় এবং বৈঠক শেষ না হওয়ায় অনুমতি নিয়ে চলে আসি এবং যথা সময়ে প্রশিক্ষণস্থলে উপস্থিত হই, আর হুজুরও যথাসময়ে উপস্থিত হন। হুজুরের কাছ থেকেই প্রথম সাংগঠনিক সবক (প্রশিক্ষণ) গ্রহণ করি। হুজুরের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার আনন্দ নিয়ে যথাসময়ে মাদরাসায় চলে আসি।
আত তাগলীব : ঢাকার বাহিরে সংগঠনের একটি মজবুত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল নরসিংদী। প্রাথমিক সময়ে নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে কার্যকরী পদক্ষেপগুলো কী ছিল বলে মনে করেন?
রাকিবুল ইসলাম রকিব : শুরুর দিকে আমাদের কাজটা মূলত ঢাকা, নরসিংদী ও খুলনা কেন্দ্রিক ছিল। তবে নরসিংদীতে ছাত্রদের মাঝে কাজ খুব সাড়া ফেলেছিল। যদিও তখন পরিবেশ সম্পূর্ণ প্রতিকূল ছিল। নরসিংদীতে যাদের মাধ্যমে কাজ মজবুতি পেয়েছে, তাদের সবার মধ্যে একটা বিষয় লক্ষ করেছি যে, দ্বীন বিজয়ের এ মেহনতকে নিজের কাজ মনে করে করতেন এবং তখন গ্রুপটা এমন ছিল যে সবাই কাজের ব্যাপারে সিরিয়াস ছিল। এবং কখনো সংগঠনের কাজের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কাজকে প্রাধান্য দিতোনা। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হল ‘বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস’ যে চিন্তা চেতনা বৈশিষ্ট্য ও কর্মপন্থাকে লালন করতো তা ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠা করার একটি চিন্তা সবার মধ্যে কাজ করতো। তখন মসজিদে সামনের কাতারে নামাজ আদায় করা, নফল নামাজ, রোজা ও আমল আখলাকের ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হতো। এ বিষয়গুলো দাওয়াত হিসাবে কাজ করেছে। প্রত্যেক মাসে সকল জনশক্তি একসাথে ২ টা নফল রোজা রাখতাম আর এ রোজা রাখার কারণে ক্লাস করা তাকরার করা ও সবক মুখস্থ করাসহ প্রতিষ্ঠানের কানুনের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অবহেলা করতাম না, এ বিষয়টি সবার মাঝে ভালো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, এভাবেই আস্তে আস্তে নরসিংদীতে ‘বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস’ এর ঘাঁটি হিসাবে পরিচিতি পায়।
আত তাগলীব : ছাত্র মজলিস বিশেষ শাখা নামে কাজ শুরু করলেন। পরিবর্তন করে নাম রাখা হলো ‘বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস’। আবার আপনার সেশনেই নাম পরিবর্তন হয়ে করা হলো ‘বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস (খ শাখা)’ এর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই।
রাকিবুল ইসলাম রকিব : ছাত্র মজলিস বিশেষ শাখা নামে অল্প কিছুদিন কাজ করার পর সকলের পরামর্শের ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস’ নামে কাজ করতে থাকি। এভাবে দীর্ঘদিন কাজ করার কারণে এ নামটা রক্তের সাথে মিশে যায়। এক সময় আলোচনা হয় যে, যুব মজলিস বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সহযোগী সংগঠন করার। তখন সঙ্গত কারণেই দুই ছাত্র সংগঠনকে একীভূত করার আলোচনা হয়। আর তা আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস খেলাফত মজলিসের সহযোগী সংগঠন হিসাবে সমঝোতা হয়। তখন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস নাম রহিত করার কথা বলা হয়, তবে বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস ছাত্রদের মাঝে কাজ করতে পারবে বলে অনুমতি দেওয়া হয়। তখন মাওলানা মামুনুল হক সাহেব হুজুরসহ সকলের পরামর্শক্রমে ‘বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস খ শাখা’ নামে ছাত্রদের মাঝে কাজ করার সিদ্ধান্ত হয়। যখন নাম পরিবর্তনের আলোচনা হয় তখন সবচেয়ে বেশি আমি বিরোধিতা করেছিলাম, কারণ এতদিন যে নামটার উপর দ্বীন বিজয়ের স্বপ্ন দেখছিলাম, তা পরিবর্তনে হৃদয়ের গহীনে একটা ধাক্কা লাগে। তবে সর্বশেষ সিদ্বান্ত অনুযায়ী কাজ করতে থাকি। এভাবে বারবার ব্যানার পরিবর্তন হওয়ার পরও বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস যেভাবে পরামর্শ দিয়েছে তা নিয়েই অদম্য স্পৃহায় কাজ করেছি; আমি বিশ্বাস করি যে, আপনাদের মাধ্যমে এদেশে এ’লায়ে কালিমাতুল্লাহর পতাকা উড্ডীন হবে।
আত তাগলীব : ছাত্রসংগঠন থেকে এখন যুব মজলিসের ঢাকা মহানগরের দায়িত্ব পালন করছেন। সাংগঠনিক জীবনটাকে যেভাবে মূল্যায়ন করবেন?
রাকিবুল ইসলাম রকিব : আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে দেখতে দেখতে সাংগঠনিক জীবনের ১৬ টি বছর অতিক্রম করলাম; এর চাইতে বড় পাওয়াতো আর কিছু হতে পারেনা। ছাত্রসংগঠনে থাকাবস্থায় যে পরিমাণ সময় দিতে পারতাম, যুবসংগঠনে আসার পর কর্মজীবনে প্রবেশের কারণে ওইভাবে সময় দিতে পারিনা। তবে সবসময় চেষ্ট করি নিয়মিত সময় দেওয়ার জন্য। আমার সাংগঠনিক জীবনে অনেক বাঁধা বিপত্তি এসেছে কিন্তু কখনোই দ্বীনি আন্দোলন থেকে দূরে সরে যাইনি।
আত তাগলীব : প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলনে ছাত্রসংগঠনের পক্ষ থেকে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তখনকার অনুভূতি কী ছিল?
রাকিবুল ইসলাম রকিব : ‘বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের প্রথম কেন্দ্রীয় সম্মেলন’ ভিতরে আলাদা একটা ভালো লাগা কাজ করছিল। নরসিংদীতে তখন যুব মজলিসের কাজ ছিল না, তবে ছাত্রদের মজবুত কাজ ছিল। আর নরসিংদী ঢাকার কাছে হওয়ায় দায়িত্বও বেশি ছিল। সম্মেলন সফল করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এর মধ্যে কেন্দ্র থেকে জানানো হলো সম্মেলনে আমার বক্তব্য দিতে হবে। বক্তৃতায় আমি ততো পারদর্শী না, যতটা মানুষ চায়। যাই হোক সম্মেলনের ব্যস্ততার কারণে ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়নি। এদিকে সম্মেলনে আসার দিন বাদ ফজরে সময় ঘটলো এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা, তার জন্য পড়তে হলো বিরাট বিপত্তিতে। এই কারণে যথাসময়ে রওয়ানা দিতে পারিনি, তারপরেও আল্লাহর রহমতে যথাসময়ে সম্মেলনস্থলে উপস্থিত হই। এবং সময় অনুযায়ী ছাত্রদের পক্ষ থেকে আমার নাম ঘোষণা হয় এবং আমি বক্তব্য দিতে মঞ্চে ওঠি, এবং বক্তব্যও দেই। যদিও বক্তব্য বা পদ-পদবির জন্য কাজ করিনা, তারপরেও প্রথম সম্মেলনে ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবে বক্তব্য দেওয়া ভিতরে অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করেছিল, যা আজোও হৃদয়পটে তরতাজা।
আত তাগলীব : অনুজদের উদ্দেশ্যে দীর্ঘ সাংগঠনিক জীবনের অভিজ্ঞতায় যে নির্দেশনা দিতে চান।
রাকিবুল ইসলাম রকিব : আসলে বলার মত তেমন কোন অভিজ্ঞতা আমার নেই। তবে একটি বিষয় আমার কাছে খুব কার্যকর মনে হয় যে, সমস্ত জনশক্তির মাঝে একটা নেটওয়ার্ক স্থাপন করা, উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সকল জনশক্তির সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা এবং কাজের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা ও নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় রাখা। আপনি কাজের ক্ষেত্রে যত কৌশলই অবলম্বন করেন না কেন, যদি অধারাবাহিক ও অনিয়মিত থাকেন তাহলে কখনো সফলতা অর্জন করতে পারবেন না।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের কে সঠিকভাবে দ্বীন বিজয়ের কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকার তাওফিক দান করুন আমিন।
আত তাগলীব : ভালো থাকবেন, দোয়া করবেন।
রাকিবুল ইসলাম রকিব : জি, আলহামদুলিল্লাহ। আপনারাও দোয়া করবেন।