মাওলানা জাহিদুজ্জামান। জেনারেল শিক্ষিত পরিবারের একজন সন্তান। কিন্তু তার ধ্যান ধারণা চিন্তা চেতনা আপদমস্তক তিনি একজন ইসলামপ্রিয় মানুষ। খেলাফত ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে যুব মজলিসের সাথী হয়েছেন। মেধা ও যোগ্যতার বলে অতিদ্রুতই তার কাঁধে অর্পিত হয়েছে খা শাখার সভাপতির দায়িত্ব। পালন করেছেন সেইভাবে। দিনকে রাত, রাতকে দিন বানিয়ে সংগঠনের জন্য দৌড়েছেন একজেলা থেকে অন্যজেলা, একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। প্রশিক্ষণ বিভাগে করেছেন জোরালো সংযোজন। তার দুই সেশন ছিল কাজের বিস্তৃতি, পুরাতন কাজের নবায়ন ব্যাপক সাংগঠনিক সফরের আমেজ। খ শাখার অগ্রগতিতে তার ত্যাগ তিতিক্ষা ও ফেলে আসা স্মৃতিগুলো জানতে এক বিকালে তার মুখামুখি হয়েছিলেন বর্তমান বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস খ শাখার সভাপতি আল আবিদ শাকির- সম্পাদক।
আত তাগলীব : সাংগঠনিক কাজের সঙ্গে কীভাবে জড়িত হয়েছিলেন?
জাহিদুজ্জামান : ২০০৮-৯ ইং শিক্ষাবর্ষে জামিয়া রাহিমানিয়ায় শরহেজামী জামায়াতে পড়ি। সেসময় সহপাঠি জাহিদুল আলম ও ইমরান হুসাইন ভাই ইসলামী ছাত্র মজলিস বিশেষ শাখার (বর্তমান যুব মজলিস খ শাখা) বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে যেতেন। তখন থেকেই কিছুটা জানার আগ্রহ তৈরি হয়। সেটা ছিল শিক্ষাবর্ষের শেষ দিকে। পরবর্তী শিক্ষাবর্ষে ছাত্র কাফেলার রুমে সংগঠনের একটি দাওয়াতি মজলিসে আনুষ্ঠানিকভাবে ফরম পূরণের মাধ্যমে দ্বীন বিজয়ের এই কাফেলার অংশ গ্রহণ করার তাওফিক হয়। দ্বীনী ভাই শরীফ হুসাইন আমাদের সেখানে কর্মী ঘোষণা করেন। (হয়তো তখনকার নিয়ম এমনি ছিল, এখন সদস্য হওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় প্রশিক্ষণ ব্যতীত কর্মী হওয়ার সুযোগ নেই। তবে আমরা সদস্য প্রশিক্ষণ করেছিলাম)
আত তাগলীব : কণ্টকাকীর্ণ এ পথে যাত্রা শুরু করতে কোন বিষয়টি প্রেরণা যুগিয়েছিল?
জাহিদুজ্জামান : সংগঠনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো বিশেষভাবে দায়িত্বশীলদের আন্তরিকতা, ভালোবাসা, হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ, যুব মজলিস সভাপতি মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক দা.বা. এর চিন্তা, হৃদয়ের আকুতি ও আহ্বান, হুজুরের স্নেহ আমাদের ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
হুজুরের প্রতিটি শব্দ ছিল অন্তর থেকে। আর তাতে ছিল একজন দ্বীনের দরদি মুজাহিদের ব্যাকুলতার ও কান্নার মিশেল। তাই নেতৃত্ব ও সংগঠনের এই আদর্শই ছিল অনুপ্রেরণার উৎস। অন্যথায় আমি মূলত একটি জেনারেল পরিবারের ছেলে। আমার জন্য ওই পথে অগ্রসর হওয়া কঠিন ছিল। এখনো সংগঠনের আগের (ঘরের ভেতরের বাইন্ডিং) জীবন আর এখনকার স্বাধীনজীবন নিয়ে ভাবলে আশ্চর্য হই। আর সর্বোপরি আল্লাহর তাওফিকটাই হল আসল।
আত তাগলীব : সংগঠনের প্রথম প্রোগ্রাম সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন? সংগঠনের প্রথম প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ কবে কখন? কেমন লেগেছিল?
জাহিদুজ্জামান : দুটি প্রশ্ন করেছেন, উত্তরটা একসঙ্গে দিচ্ছি। কারণ তখন প্রশিক্ষণ ছাড়া অন্য প্রোগ্রাম তেমন হতো না। সংগঠনে অন্তর্ভুক্তির পর প্রথম প্রোগ্রাম ছিল প্রশিক্ষণচক্র। প্রশিক্ষক ছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক দা.বা.। রাত প্রায় এগারোটায় শুরু হওয়া ক্লাসটি ১২.৩০ টায় শেষ হয়েছিল। ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে তা হয়েছিল। সঠিক তারিখটি মনে নেই। অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করছিল। নতুন কিছু শিখেছিলাম; সাংগঠনিক বিষয়গুলো স্পষ্ট হচ্ছিল। এর বাহিরে প্রথম কর্মশালা ও ৫ দিনব্যাপি প্রথম প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের আবেগময় স্মৃতিগুলো আজও হৃদয়ে নাড়া দেয়। কত সুন্দর ও সুশৃঙ্খল ছিল সেই প্রোগ্রামগুলো। তখন স্থানের সঙ্কট ও প্রশাসনিক চাপে প্রোগ্রামের মাঝেই তড়িঘড়ি করে স্থান পরিবর্তন এতোসব ঝামেলার মাঝেও প্রশিক্ষণ গ্রহণে আত্মতৃপ্তির ঘাটতি তৈরি হয়নি।
আত তাগলীব : সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর আপনার অনুভূতি কী ছিল?
জাহিদুজ্জামান : দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার মহান সংগ্রামে ‘যুব মজলিস খ শাখার’ দায়িত্বশীলদের তত্ত্বাবধানে একজন নগন্য কর্মী হিসেবে কিছু সময় পর্যন্ত কাজ করার সুযোগ হয়েছে। একটা সময়ে কিছুটা শূন্যতার সৃষ্টি হলে দায়িত্বভার আমার কাঁধে এসে পড়ে।
তবে সংগঠনের শুরু থেকেই একটা শিক্ষা ছিল যে, দায়িত্বের প্রতি আকাক্সক্ষা থাকা যাবে না। তবে দায়িত্ব এসে গেলে কোনো ধরনের লৌকিকতার আশ্রয় নেয়া উচিৎ নয়। তাই অনুভূতিটা ছিল মিশ্র। একদিকে দায়িত্বের ভার অপরদিকে দায়িত্ব এসে গেলে খোদায়ি নুসরতের ওয়াদা। যেহেতু দায়িত্ব চেয়ে নেয়া হয়নি তাই, আল্লাহর সাহায্য থাকবে এই বিষয়টি সাহস যুগিয়েছিল।
আত তাগলীব : সেসময় সহ-দায়িত্বশীলদের সহযোগিতা কেমন পেয়েছিলেন?
জাহিদুজ্জামান : আলহামদুলিল্লাহ্! অভিভাবক পরিষদ, নির্বাহি কমিটি থেকে নিয়ে সংগঠনের সকল পর্যায়ের দায়িত্বশীল ও কর্মীদের আন্তরিক সহযোগিতার কোনো ঘাটতি ছিল না। বিশেষ করে উভয় সেশনে সভাপতি পরিষদ সদস্যদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা। মূলত তারাই বেশির ভাগ কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন।
আত তাগলীব : সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্তির পর যে সকল উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন?
জাহিদুজ্জামান : সংগঠনের দায়িত্বটা এমন সময়ে নিতে হয়েছিল যখন কাজটা প্রায় আবার নতুন করে শুরুর পর্যায়ে ছিল। দায়িত্বশীলের সঙ্কটের দরুন কাজে স্থবিরতা এসে পড়েছিল। অফিসিয়াল কাগজপত্রগুলো নতুনভাবে লাইনআপ করা, সারাদেশের শাখাগুলোকে নতুন করে দায়িত্বশীল নির্বাচনের মাধ্যমে গঠন করা। সভাপতি পরিষদ নির্বাচনের পর সারাদেশে সফর করে বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের সাথে বারবার কন্টাকের (যোগাযোগ) মাধ্যমে নির্বাহি কমিটি ঘোষণা করা হয়। এছাড়া প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মানবৃদ্ধির লক্ষ্যে সিলেবাস প্রণয়ন, উপরের স্তরের দায়িত্বশীলদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া।
সংগঠনের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল যা এই সেশনের (২০১৮) দায়িত্বশীলদের মাধ্যমে প্রকাশের পথে (ইনশাল্লাহ)। সমাজকল্যাণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। প্রথমবারে মূলত আমরা বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি হাতে নেই এবং আলহামদুলিল্লাহ্! সেবারই কুড়িগ্রাম ও মানিকগঞ্জের তিন স্থানে প্রায় ১০০০ পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। সমাজকল্যাণের কাজ পূর্ব থেকেই ছিল সেটাকে সংগঠনের ৫ দফা কর্মসূচির একটি হিসেবে ধারাবাহিকতার রূপ দেয়ার উদ্যোগ ছিল এখন প্রতিটি শাখায় স্বল্পপরিসরে হলেও ধারাবাহিকভাবে সেটা চলছে।
সবচে’ চ্যালেঞ্জিং ছিল খ শাখার উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সম্মেলন বাস্তবায়ন করা। ঊর্ধ্বতন সংগঠন যুব মজলিসের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় সম্মেলন করার নির্দেশ ছিল। যেহেতু আমাদের বহির্মুখী কার্যক্রম কম তাই এতোবড় প্রোগ্রামের আয়োজন করা সহজ ছিল না। পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পরিকল্পনা নিয়ে সুন্দরভাবেই আল্লাহর রহমতে সম্মেলন বাস্তবায়ন হয়েছিল। ছাত্রসমাজের মাঝে এর একটি প্রভাবও পরিলক্ষিত হয়েছে। উপস্থিতিসহ আরও সার্বিক সকল টার্গেট আল্লাহর রহমতে পূর্ণতা পেয়েছিল। সম্মেলন উপলক্ষ্যে প্রথমবারের মূলত ‘আত তাগলীব’ নামে সম্মেলন স্মারক প্রকাশ করা হয়েছিল।
আত তাগলীব শিল্পীগোষ্ঠী নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন, কেন্দ্রীয় সাহিত্য ও গবেষণা বিভাগের তত্ত্বাবধানে আত তাগলীব সাহিত্য ফোরাম, মিডিয়ার জন্য আত তাগলীব মিডিয়া ও আত তাগলীব ব্লাডগ্রুপ নামে রক্তদান সংগঠন এর প্রকাশও হয়েছিল। অবশ্যই এগুলো অধস্তন দায়িত্বশীলদের আগ্রহ ও উদ্দীপনারই ফলাফল ছিল। তবে সুযোগ ছিল অনেক কাজের কিন্তু নিজের দুর্বলতার কারণে করতে পারিনি। রাব্বে কারীমের দরবারে কী জবাব হবে তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। আল্লাহ ক্ষমা করুন। আমিন।
আত তাগলীব : যুব মজলিস খ শাখার এমন কী কর্মসূচি আছে যাতে সংগঠনের কর্মীরা শুধু ইসলামি আন্দোলন ও বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হবে না; বরং ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনেও যোগ্য হবে?
জাহিদুজ্জামান : আপনি যুব মজলিস খ শাখার লক্ষ্য উদ্দেশ্য দেখুন, তাহলে দেখবেন যে সেখানে লক্ষ্য অর্জনকে চারটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। যার মধ্যে প্রথমটিই হল ’ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ যোগ্য ব্যক্তি গঠন’ অর্থাৎ ব্যক্তিগঠনটাই হল আমাদের লক্ষ্য অর্জনের প্রথম ধাপ। সংগঠনের বর্তমান প্রায় সকল কর্মসূচিই এই ধাপকে কেন্দ্র করেই। যারাই সংগঠনে অংশগ্রহণ করবে প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে সমাজ পরিচালনার সঠিক যোগ্যতার পাশাপাশি নিবেদিতপ্রাণ (মুখলিস) হিসেবে গড়ে তুলতে বাহ্যিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি আত্মিক প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে। আর এসবের মাধ্যমে কিন্তু একজন ছাত্র একাডেমিক শিক্ষার অতিরিক্ত আরো অনেক যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট গ-ির চিন্তার বাহিরে সে ব্যাপক পরিসরে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে। আর বড় কথা হচ্ছে, সে একজন দায়িত্বশীল হিসেবে গড়ে উঠছে। আর আমি মনে করি ‘দায়িত্ববোধ’ হল একজন ব্যক্তির অন্য সকল অর্জনের মূলচাবিকাঠি। তাই এবিষয়গুলো তার একাডেমিক পড়াশুনায় উন্নতির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে এবং এই যোগ্যতাগুলোই তার পরবর্তী কর্মজীবনের পথকেও অনেক সহজ করে তুলছে এর উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে।
আত তাগলীব : একটি আদর্শ ছাত্র সংগঠনের কী কী বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন বলে মনে করেন?
জাহিদুজ্জামান : যেহেতু ছাত্র সংগঠন তাই এখানে সংগঠনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি মজবুত হতে হবে। নিত্য নতুন প্রয়োজনীয় বিষয়ের জ্ঞানচর্চার পরিবেশ সংগঠনের ভিতরে থাকতে হবে এবং সংগঠনের নেতৃত্বের আসনে যারা থাকবেন তাদেরকে অবশ্যই ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তার বাহক, জ্ঞান-চরিত্র ও অনুপম আদর্শ ও ত্যাগ ও কোরবানির নজরানা পেশের মাধ্যমে একজন যোগ্য আদর্শিক দায়িত্বশীলের মডেল হিসেবে পেশ করতে হবে। ছাত্রদের মধ্যে অনুকরণের একটি স্বভাব প্রাকৃতিকভাবেই থাকে তাই তাদের অনুকরণীয় ব্যক্তিদের তেমনই হতে হবে।
আত তাগলীব : সংগঠনকে কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত করতে দায়িত্বশীলদের আরো কী কী পরার্মশ দিবেন?
জাহিদুজ্জামান: আল্লাহর অশেষ রহমতে সারাদেশের ছাত্র তরুণ সমাজের মাঝে যুব মজলিস ও যুব মজলিসের নেতৃত্ব সর্ম্পকে ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। ছাত্রসমাজ দাওয়াত কবুলের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের ইখলাস, চিন্তা, আর্দশ ধওে রেখে দলের র্কমসূচিতে নতুনত্ব সৃষ্টি এবং যুগের চাহিদানুযায়ী কল্যাণকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নতুন প্রজন্মের জন্য অধিকতর কার্যকরী দাওয়াতী র্কাযক্রম পরিচালনা করতে হবে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংগঠনের প্রতিটি দায়িত্বশীলদের দাওয়াত নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক সফর করতে হবে। সংগঠিত জনশক্তিকে কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছাতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলোর ধারাবাহিকতার পাশাপাশি নিত্যনতুন র্কমসূচি হাতে নিতে হবে। সংগঠনকেই দায়িত্বশীলদের প্রধান কাজ হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ইনশাআল্লাহ এর মাধ্যমেই কাঙ্খিত মানে আমরা পৌঁছতে পারবো। খোদার জমিনে হেলালী নিশান উড়বেই ইনশাআল্লাহ।