দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : যখন সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখনকার অনুভূতি কী ছিল?
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : তখন বিশেষ কোন নতুন অনুভূতি ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি। তবে নিজের অযোগ্যতা ও দুর্বলতার কথা ভেবে শঙ্কিত ও হতাশাগ্রস্থ ছিলাম।
দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : আপনি সংগঠনে কিভাবে যুক্ত হলেন? এ ব্যাপারে কিছু বলুন!
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : আমরা কিছু ভাই ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের কর্মী ও দায়িত্বশীল ছিলাম। বিভিন্ন কারণে ঘটনায় আমরা সংগঠন থেকে নিস্ক্রিয় ও প্রচন্ড রকম নিরাশ ছিলাম। এরপর ২০০৯ সালে যখন ছাত্র মজলিস ও ঢাকা মহানগরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিলো তখন একদিন মাওলানা মামুনুল হক সাহেব আমাদের ডাকলেন। তিনি ছাত্রজীবনে সুনির্দিষ্ট অধ্যয়ন ও বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে আমাদেরকে পুনরায় সক্রিয় হতে বললেন। আমরা বিনয়ের সাথে অপারগতা প্রকাশ করি। পুরনো অপ্রাপ্তি আর হতাশার কথা বলি। তিনি শুনলেন। আবার ডাকলেন। বললেন ও শুনলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন, নিজ সময়, প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে আমাদের অপ্রাপ্তি অতৃপ্তি দূর করবেন। আমরা জানালাম, আপনার যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্বে আমাদের আস্থা আছে। তবে পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের বিরক্ত ও হতাশ করে দিয়েছে। এরপর আমাদের আরো বৈঠক হয়েছে। মুহাম্মদপুরে মাদরাসায় ও বাংলাবাজারে হুজুরের জুমার মসজিদে। তিনি বললেন, কিছুদিন সময় দিয়েই দেখো তোমরা! এরপর যদি ভালো না লাগে তাহলে সরে যেও। এভাবেই শুরু আমাদের পথচলা। আজ দশ বছর পূর্তিতে হৃদয়ের গহীন থেকে বলি, আলহামদুলিল্লাহ!
দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : শৈশব থেকেই সংগঠনের সঙ্গে পরিচিতি। নতুন করে নতুন সংগঠনের পথে হাটতে শুরু করলেন। কোন দিকগুলো আপনাকে এ পথে অগ্রসর হতে সাহস যুগিয়েছিল?
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : আমি তৎকালীন অবিভক্ত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র মজলিসের বারংবার প্রাথমিক সদস্য হয়েছি। তখন পড়াশোনার ব্যস্ততা ও অল্পবয়সী হওয়ায় খুব বেশি কাজ করা হয়নি। বিভক্ত হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে কর্মী ও সহযোগী সদস্য হয়েছি। কিন্তু সংগঠন করে কোন মানসিক তৃপ্তি দূরের কথা, উল্লেখযোগ্য কিছু শেখারও সৌভাগ্য হয়নি। এছাড়া ইশা ছাত্র আন্দোলন, খেলাফত ছাত্র আন্দোলন ও তৎকালীন ছাত্র মোর্চাকে পারিবারিকভাবেই খুব কাছ থেকে দেখেছি, জেনেছি। সবমিলিয়ে আমি কখনো প্রচলিত কোনো সংগঠনে সক্রিয় না হওয়ার ব্যাপারেই দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ ছিলাম। তবে সবসময়ই সংঘবদ্ধ শক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতাম। বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিসের সাথে সময় দিয়ে আমার মনে হলো, আমি এমন কাফেলারই প্রতীক্ষায় ছিলাম। সংগঠনের ধারাবাহিক বহুমুখী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, কর্মীদের আধ্যাত্মিক মানোন্নয়ন, কঠোর শৃঙ্খলা, অসাধারণ নিয়মতান্ত্রিকতা ও নিপুণ কর্মপরিকল্পনা আমাকে এ সংগঠনে যুক্ত হতে বিপুল শক্তিতে আকর্ষণ করেছে।
দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : সংগঠনের প্রথম প্রোগ্রাম সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : সংগঠনের প্রোগ্রাম বলতে সাধারণত আমরা বুঝি, সম্মেলন, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের প্রথম প্রোগ্রাম ছিল ইসলাহি মজলিস। এবং এটাই সংগঠনের প্রধানতম প্রোগ্রাম। সেখানে গিয়ে সংগঠনের আধ্যাত্মিক দিকের সন্ধান পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম।
দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : সংগঠনের প্রথম প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা হয়েছিল? কেমন লেগেছিল?
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ অংশ নেয়ার সুযোগ দিয়েছেন। ৫ দিনব্যাপী এ প্রশিক্ষণ আমাদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে। প্রশিক্ষণের মূল দায়িত্বশীল ছিলেন আমাদের তত্ত্বাবধায়ক, যুব মজলিসের মুহতারাম সভাপতি মাওলানা মামুনুল হক হাফিজাহুল্লাহ। উস্তাদ মুহতারাম আমাদের ৫ দিন আগাগোড়া পূর্ণ সময় দিয়েছেন। তাঁর ও অন্যান্য আলোচকদের আলোচনাগুলো থেকে যেমন বেশ কিছু জেনে উপকৃত হয়েছি। তেমনি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়েও শিখেছি। সেই সাথে দেখেছি, একজন স্বভাবজাত রাশভারী গাম্ভীর্যপূর্ণ দায়িত্বশীল শিক্ষার্থীদের সাথে কতটা আন্তরিক, স্নেহশীল ও মিশুক হতে পারেন। সবচে বড় বিষয় হলো, এ প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম থেকে আমি এমন কিছু ভাই পেয়েছি, যাদের ব্যাপারে নির্দ্বিধায় আরবি এ প্রবাদ প্রণিধানযোগ্য,
“رب أخ لك لم تلده أمك”
প্রশিক্ষণ কর্মশালায় পূর্ণসময় অংশগ্রহণকারী সকলের মধ্যে এক চমৎকার ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে উঠেছিল। যা এখনো অটুট আছে আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ ইহকালে ও পরকালেও এ সম্পর্ক দৃঢ় রাখুন।
দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : প্রথম দিকের দাওয়াতি কাজ কিভাবে করতেন?
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : প্রথম দিকে দাওয়াতি কাজ ব্যাপক ছিল না। কাজের পরিসর খুবই সীমিত ছিল। একজন একজন টার্গেট করে দাওয়াত দেয়া হতো। কাউকে কখনো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সদস্য করা হয়নি। জোর করে ফরম ধরিয়ে দেয়া তো দূরের কথা, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ফরম ছাপানো হয়নি। দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, আগে নিজেদের মধ্যে সংগঠন চর্চা ও মজবুতি অর্জন। পরে বিস্তৃতি লাভ। মামুনুল হক সাহেব হুজুর সবসময় বলতেন, ‘একটা মজবুত সংগঠনের জন্য মানুষ চাতকপাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে। আমরা যদি তা করতে সক্ষম হই তাহলে মানুষকে দাওয়াত দিয়ে সংগঠনে আনতে হবে না বরং মানুষই খুঁজে খুঁজে সংগঠনে এসে যোগদান করবে।’
দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : শুরুর দিকে সংগঠনের কাজ করতে যেয়ে কোন বিষয়টি আপনাদের কাছে বেশি চ্যালেঞ্জের বলে মনে হয়েছে? তা কিভাবে মোকাবেলা করেছেন?
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : দুটি বিষয় খুব চ্যালেঞ্জের মনে হতো। সংগঠনবিমুখ তরুণ ছাত্র সমাজের মধ্যে সংগঠনের প্রতি আগ্রহ তৈরি করা এবং প্রচলিত ছাত্র সংগঠনগুলোর মিছিল মিটিং নির্ভরশীল রাজনীতিমুখী মানসিকতা পরিহার করে ব্যাপক অধ্যয়ন ও মানসম্মত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জ্ঞাননির্ভর সংগঠন গড়ে তোলা। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সংগঠন এখন পর্যন্ত ভালোভাবেই উতরে যাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ! দ্বিতীয় বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপের কারণে মেধাবী, উদ্যোমী ও আশাবাদী তরুণদের প্রিয় ঠিকানা বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস।
দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : সংগঠনের কর্মসূচিগুলো কিভাবে প্রণয়ন করতেন?
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : সংগঠনের কর্মসূচি বলতে প্রাথমিকভাবে ছিল- প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, ইসলাহি মজলিস, দাওয়াতি মিছিল, দাওয়াতি মজলিস ও তারবিয়তি সফর। এরমধ্যে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম ও দাওয়াতি মজলিসের ব্যাপারে আমরা পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিভাবক পরিষদ প্রধান মাওলানা মামুনুল হক সাহেবের সাথে পরামর্শ করে নিতাম। আর অন্যান্য কর্মসূচিতে যুব মজলিসের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তের আলোকে ছাত্র সংগঠন অংশগ্রহণ করে বাস্তবায়নে সহযোগী হতো।
দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : সবচেয়ে স্মরণীয় সাংগঠনিক সফর?
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : অনেকগুলো সফরই স্মরণীয় হয়ে আছে। তবে তালিকায় ২০১০ সালে সুনামগঞ্জ সফরকে প্রথমে রাখতে হবে। প্রোগ্রাম ছিল শুক্রবার সকাল ১০টায় দাওয়াতি মজলিস। আর্থিক সংকটের কারণে একজনের সফর।
শ্রদ্ধেয় শরীফ হুসাইন ভাই বৃহস্পতিবার দুপুর সময়ানুযায়ী জয়ন্তিকা ট্রেনের টিকেট করে রেখেছেন। আল্লাহর ইচ্ছা, অনেকক্ষণ দৌড়েও ট্রেনের নাগাল পেলাম না। ট্রেন মিস করলাম। ফিরতি যাত্রার জন্য সংরক্ষিত টাকা দিয়ে রাতের উপবন ট্রেনের স্ট্যান্ডিং টিকেট কেটে কমলাপুর বসে থাকলাম। দুই ট্রেনের সময়ের ব্যবধান প্রায় ১০ ঘণ্টা। যতদূর মনে পড়ে, বাস ভাড়া সেসময় ট্রেনের চেয়ে বেশিই ছিল। ক্ষুধাপিপাসা ও প্রচন্ড ঘুমের চাহিদা নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে সিলেট অবধি পুরোটা জার্নি দাঁড়িয়ে সফর করলাম’ এ সফর স্মরণীয় না হয়ে উপায় কী!
দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : সাংগঠনিক জীবনের সবচেয়ে ভালো লাগার অনুভূতি যখন সৃষ্টি হতো?
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : যখন সাংগঠনিক কাজের মাধ্যমে আমার ও অন্য ভাইদের আত্মিক উন্নতি অনুভব করতাম।
দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : আজকের এ পর্যায়ে সংক্ষিপ্তভাবে সংগঠনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে যা বলবেন?
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : সংগঠন আলহামদুলিল্লাহ বিগত কয়েক বছরে প্রভূত উন্নতি লাভ করেছে। এবং দেশব্যাপী মেধাবী তরুণদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে দ্রুতই প্রসার লাভ করছে আমাদের প্রিয় সংগঠন। তবে স্কুল কলেজের মধ্যে আমরা এখনো আশানুরূপ কাজ তৈরি করতে সক্ষম হইনি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস বর্তমান এ নিষ্ফলা সময়ের আশাজাগানিয়া ও সম্ভাবনাময় একটি সংগঠন।
দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : ছাত্র সংগঠন ও ছাত্ররাজনীতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কিছু বলবেন?
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : অনেকে মনে করেন, ‘সংগঠন মানেই রাজনীতি’। এ ধারণা সঠিক নয়। রাজনীতি রাষ্ট্র সংক্রান্ত দায়দায়িত্ব আর সংগঠন হল সংঘবদ্ধতা। মানুষের জন্য সংঘবদ্ধতার কোন বিকল্প নেই। ছাত্রজীবনে সংগঠন মানুষকে সামাজিক ও দায়িত্বশীল হতে শেখায়। একটি কল্যাণমুখী সংগঠন তার কর্মীদের নৈতিক ও আদর্শিক উৎকর্ষ সাধনে বড় সহায়ক হয়। আর ছাত্ররাজনীতির প্রসঙ্গে তো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আগেই উল্লেখ করেছি। তাই আমি মনে করি, ছাত্রজীবনে রাজনীতি বিষয়ক পাঠ ও অধ্যয়ন হতে পারে। কিন্তু এর প্রায়োগিক চর্চা কোনভাবেই কাম্য নয়। ছাত্রদের দাবি আদায়ে ও তাদের সংগঠিত রাখতে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ছাত্রদের ব্যবহার বা ছাত্রদের রাজনৈতিক ভূমিকাপালন দিনশেষে কোন সুফল বয়ে আনবে না।
দশবছর পূর্তি স্মারকগ্রন্থ : অনুজদের জন্য বিশেষ কোন নির্দেশনা?
মাওলানা ইমদাদুল্লাহ : নির্দেশনা নয়, পরামর্শ বলা যায়। অনুজদের উদ্দেশ্যে বলব, সংগঠনের মূল চ্যালেঞ্জ সামনে অপেক্ষা করছে। আরো দৃঢ় ও শক্তিশালী হয়ে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ। আমাদের পর্বতসম উচ্চ মানসিকতা, বিশাল হৃদয় ও সুকঠিন প্রত্যয়ের অধিকারী হতে হবে। ক্রমান্বয়ে আমাদের দেশের ধর্মীয় পরিস্থিতি খুব কঠিন ও সঙ্কটাপন্ন হচ্ছে। নিত্য নতুন জটিলতা তৈরি হচ্ছে। সামান্য সুবিধা ও অস্থায়ী তুচ্ছ ক্ষমতার জন্য অনেকে ধর্মীয় স্বার্থ বিসর্জন দিচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ও শাহাদাতের তীব্র আকাঙ্ক্ষার কোন বিকল্প নেই। নিজের জীবনের সবকিছুর বিনিময়ে হলেও ইসলামকে এবং ইসলামের দাবিকে সর্বাগ্রে রাখতে হবে।