ছাত্র মজলিসের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী দায়িত্বশীল ও কর্মীদের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠি
দায়িত্বশীল ও কর্মী ভাইয়েরা।
আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
জালিমের জিম্মানখানায় বন্দী অবস্থায়ও মনে বড় আনন্দের উদ্রেক হয় যখন জানতে পারি যে, আমাদের প্রাণপ্রিয় কাফেলা তার অভিষ্ট লক্ষ্যেপাণে এগিয়ে চলছে। আমাদের সংগঠনের ভাইয়েরা দ্বীন কায়েমের যোগ্য কর্মী হিসাবে নিজেদেরকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও মনে বড় আশা ছিল তোমাদের রমযান পূর্ববর্তী গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামগুলোতে শরীক থাকব। কিন্তু ঘটে তো সেটাই যেটা কুদরতের ফায়সালা থাকে এবং হয়তো এর মধ্যেই নিহিত আছে অধিকতর কল্যাণ।
فعسی ان تكرهوا شيئا وهو خير لكم
‘আর এটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, কোন বিষয় তোমরা অপছন্দ কর অথচ সেটাই তোমাদের জন্য অধিক কল্যাণকর।

প্রাণপ্রিয় ভাইয়েরা!
জালিমের কারাগারের লৌহ-প্রাচীর হয়তো আমার দেহকে তোমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, কিন্তু আমার হৃদয় আমার মন তোমাদের সাথেই আছে। অপারগতার কারণে আমি তোমাদের কর্মসূচিতে অংশ নিতে না পারলেও দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা যে, বন্দী থেকেও তোমাদের সাথে শরীক থাকার বিনিময় পাব। যেমনটি পেয়েছিলেন প্রিয়নবী হযরত রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় ঐ সকল সাহাবীগণ যারা তাবুক জিহাদে অংশ নিতে পারেননি অপারগতার কারণে। কিন্তু আল্লাহর নবী ঘোষণা করলেন এরা মদীনাতে আটকে থাকলেও তাবুক যুদ্ধের সফরে প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের সাথেই গণ্য হবে।

প্রিয় সহযোদ্ধা ভাইয়েরা!
আমাদের দেশে ইসলামী জাগরণের যে অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখা গেল তা আমাদের এই যমীনে খোদার দ্বীন কায়েমের সম্ভাবনাকে আরো জোরালো করে দেখিয়ে দিলো। কাজেই আমাদের সম্ভাবনা যেমন বাড়লো, আমাদের দায়িত্বও বেড়ে গেলো বহুগুন। তাছাড়া দ্বীনের গৌরব রক্ষার জন্য, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসায়ামের শান রক্ষার ঈমানী আন্দোলনে যেভাবে আমাদের ভাইয়েরা রক্ত দিয়ে মাতৃভূমির মাটিকে সিক্ত করল, শত শহীদের রক্তভেজা এই মাটিতে সেই নবীর দ্বীনকে বিজয় করতে না পারলে এ রক্তের ঋণ শোধ হবে না।

শাহিদী শপথে উদ্দিপীত ভাইয়েরা!
৫ মের নতুন বালাকোট রক্তভেজা শাপলা চত্বর থেকে আমরা যারা জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরেছি, আমাদেরকে আমাদের শহীদ ভাইদের কথা স্মরণ রাখতে হবে। যেই অপরাধে শহীদ ভাইদের বুকগুলোকে ঝাঝরা করল জালিমের বুলেট, মনে রাখতে হবে সেই অপরাধে কিন্তু আমরাও অপরাধী। সুতরাং মনে করতে হবে বস্তুত সেই শহীদদের সাথে সাথে আমাদেরও ইহকালীন চাওয়া-পাওয়ার কবর রচনা হয়ে গেছে রক্তে রাঙ্গা শাপলা চত্বরে। এখন আমাদের বেঁচে থাকা কেবল শহীদদের অসম্পূর্ণ কাজকে সম্পন্ন করার জন্য। শহীদের রক্তে ভেজা আল্লাহর এই যমীনে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় প্রতিষ্ঠার জন্য, প্রিয়তম নবীর আদর্শ কায়েমের জন্য। ব্যক্তিগত জীবনের সাময়িক চাওয়া-পাওয়া ও ভবিষ্যত জীবনে সুনাম-সুখ্যাতির ক্যারিয়ার গঠন করার আত্মপ্রবঞ্চনামূলক ধোঁকা থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে হবে। নিজের জীবনকে শহিদী জীবন মনে করতে পারলে দুনিয়ার চাকচিক্যময় রঙিন ফানুসকে শয়তানের ভেলকীবাজীর চেয়ে বেশি কিছু মনে হবে না। আল্লাহর দ্বীন আর পরকালের শাস্তিকেই মনে হবে জীবনের চূড়ান্ত বাস্তবতা।

সংগ্রামী ভাইয়েরা আমার!
আমরা আমাদেরকে প্রস্তুত করব সময়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসাবে। জ্ঞানে-গুণে, শিক্ষায়-দীক্ষায়, চরিত্রে আচরণে, যুদ্ধে-শান্তিতে, ধৈর্য্যে-ক্ষীপ্রতায়, বুদ্ধিতে-কৌশলে আমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হবে। কেননা আমরা হলাম শ্রেষ্ঠ জীবনব্যবস্থা ইসলামের সৈনিক। আমরা শিখব। কুরআন-হাদীস শিখব। ইসলামী জ্ঞানের শাখায় শাখায় পাণ্ডিত্য অর্জন করব। আবার আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় সকল শাখায় আমরা বিচরণ করব। আমরা আকাশ থেকে পাতাল পর্যন্ত সর্বস্তরে বিচরণ করব। আর এ সবই করব এক আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে। দুনিয়ার অর্থ ও সুখ্যাতির জন্য নয় বরং দ্বীনের খেদমতের জন্য। বিশেষত জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা এবং আধুনিক প্রযুক্তির উপর আমাদের আয়ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ক্যারিয়ার গঠনের জন্য নয়, শত্রুদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দ্বীনের বিজয় প্রতিষ্ঠার জন্য। শত্রুদের রণকৌশল সম্পর্কে অবগতি না থাকলে যুদ্ধে বিজয় লাভ কঠিন। এক কথায় আমরা সব জানব, সব শিখব, তবে তা হবে আল্লাহ তাআলার নির্দেশনার আলোকে
ان صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العلمين
“আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সবই রাব্বুল আলামীন আল্লাহর জন্য।” এভাবেই নিজেদের জীবনকে খোদার রাহে উৎসর্গ করার মধ্য দিয়ে আমরা একটি সংগ্রামী, সংযমী, জ্ঞানী-গুণী, উৎকৃষ্ট কাফেলা গড়ে তুলব ইনশাআল্লাহ।
প্রিয় দ্বীনী ভাইয়েরা!
তোমরা তোমাদের জীবনের স্বর্ণ সময় যৌবনের উত্তাল দিনগুলো অতিক্রম করছ। তোমাদের এই মূল্যবান সময়গুলোকে আরো বেশি মহিমান্বিত করতে সংগঠনের রয়েছে মহা পরিকল্পনা। ‘এহসার’ তথা সংগঠনের জন্য, সংগঠনের নির্দেশনায় চূড়ান্তভাবে আত্মনিবেদনই হল সেই মহা পরিকল্পনার অংশ। আমরা বরাবরই বলছি, আমাদের সংগঠনের পরিচয় হল ব্যাপকতর একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শুধু ক্যাম্পাস ভিত্তিক নয়; “যেখানেই শিক্ষার্থী সেখানেই প্রতিষ্ঠান” এই মূলনীতি হল আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কৌশল। সুতরাং এই সংগঠনে অন্তর্ভুক্তির অর্থ শুধু রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নয় বরং এই সংগঠনে অন্তর্ভুক্তির অর্থ হচ্ছে ইসলামী সমাজব্যবস্থার একজন যোগ্য কর্মী হিসাবে নিজেকে গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
কাজেই আমাদের কোন কোন পূর্বপুরুষ, বিশেষত হাকীমুল উ আশরাফ আলী খানভী (রহ.) ছাত্রকালে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারে যে অনুৎসাহিত করেছেন আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমের সাথে তার কোন বিরোধ নেই। বরং আধুনিক যুগের সাথে সামঞ্জস্যশীল অতি বৃহ পরিসরের উন্নত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হল বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস।
প্রিয় সহযাত্রী বন্ধুগন!
যে সকল মৌলিক শিক্ষা ও দর্শনকে সামনে রেখে আমাদের এই কাফেলাকে এগিয়ে নিতে হবে তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো, সংগঠনের ব্যানার, সংগঠনের নাম ও সংগঠনের নেতৃত্বের প্রচারের চেয়ে সংগঠনের চিন্তা ও বক্তব্যকে প্রাধান্য দিয়ে প্রচার করতে হবে। মনে রাখতে হবে দ্বীনের বিজয়ের জন্য জন্ম নিয়েছে এই সংগঠন। সংগঠন নয়, দ্বীনের বিজয়ই আমাদের উদ্দেশ্য। সংগঠন হলো লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম। আমাদের কর্মপন্থা হলো দ্বীন বিজয়ের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংঘবদ্ধতা তৈরি করা। আল্লাহর পথে সীসাঢালা প্রাচীরের মত দলবদ্ধতা আমরা তৈরি করব। এখানে সতর্ক থাকতে হবে, সংগঠনের প্রতি ভালোবাসা, আবেগ থাকতেই হবে কিন্তু তা যেন عصبيت বা দলবাজীতে পরিণত না হয়। আমরা লক্ষ্য অর্জনের জন্য দলবদ্ধ হব দলাদলি করব না। আর তাই আমাদের কর্মপন্থা, আমাদের কর্মকৌশল হবে সম্মিলিত কাজের ক্ষেত্রে আমরা প্রচারণার সারিতে থাকব না, থাকব পেছনের ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে।
এ উদ্দেশ্য সাধন মুখে বলা সহজ কিন্তু কাজে বাস্তবায়ন করা বড়ই কঠিন। তাই সংগঠনের সূচনাকাল থেকেই সকল জনশক্তির অন্তরে এই চেতনা বদ্ধমূল করতে হবে যে, আমরা নামের প্রচারের চেয়ে আদর্শের প্রচারকে, ব্যানার প্রতিষ্ঠার চেয়ে চেতনার প্রতিষ্ঠাকে প্রাধান্য দিব। আর এটা তখনই সম্ভব হবে যখন সকল জনশক্তি সংগঠনের চিন্তা ও চেতনাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। সংগঠনের শিক্ষা, সংগঠনের চিন্তা, সংগঠনের বক্তব্যকে আত্মস্থ না করে শুধু সংগঠনের কর্মী বা দায়িত্বশীলের পরিচয় ধারণ করলে নিজের সাথে ও সংগঠনের সাথে প্রতারণাই করা হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন।

প্রাণপ্রিয় সাথী ও বন্ধুগণ!
আমরা যে পথে নেমেছি এ পথ কিন্তু কুসুমাস্তীর্ণ বা ফুল বিছানো পথ নয়, কাঁটা ছড়ানো বন্ধুর ও রক্তস্নাত পিচ্ছিল পথ। আর এ কথাতো আল্লাহর কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা যে, ফুল বিছানো পথে নয়, কণ্টকাকীর্ণ পথের শেষ প্রান্তেই হলো খোদার জান্নাত।
আমরা দ্বীন বিজয়ের পথে চলতে গিয়ে শত্রুর প্রতিকূলতা কামনা করি না তবে সে আশঙ্কাও বিস্মৃত হই না। নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন :
لا تـتـمـنـوا لقاء العـدو فـاذا لـقـيـتـمـوهـم فـاصـبـروا
“তোমরা শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার কামনা করো না, কিন্তু যদি হয়ে যাও তবে দৃঢ়পদ থেক।”
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ হাদীস আমাদেরকে দুটি শিক্ষা দেয়।
এক. ইসলামী আন্দোলনে হঠকারিতার সুযোগ নেই।
দুই. ইসলামী আন্দোলনে ভীরুতা, আপোষকামিতা ও পশ্চাদপদতারও কোন স্থান নেই। হঠকারিতা ও ভীরুতা এই দুই প্রান্তিক মানসিকতা পরিহার পূর্বক বাস্তবমুখী দৃঢ়চেতা মনোভাবই ইসলামী আন্দোলন ও দ্বীন বিজয়ের সংগ্রামের সঠিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি। সমকালীন সময়ে আমরা আমাদের মহান রাহবার হযরত শাইখুল হাদীস (রহ.)-এর সংগ্রামী জীবনে যার বাস্তব দৃষ্টান্ত অবলোকন করেছি।

দূরস্ত যৌবনের প্রাণবন্ত সাথীগণ!
আমরা গায়ে পড়ে গণ্ডগোলে জড়াবো না। আমরা অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি করব না। আমরা ইতিবাচক ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আল্লাহর দ্বীনের বিজয়ের আহ্বান মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করব। তবে কুরআন-সুন্নাহ ও ইতিহাসের স্পষ্ট বার্তা হচ্ছে বিরুদ্ধবাদী শয়তানী অপশক্তি কখনোই আমাদেরকে সরলভাবে সামনে এগুতে দিবে না। বাধা দিবে। শুধু তাই নয়, সত্যপন্থীদেরকে তারা নির্মূল করার সম্ভাব্য সকল শক্তি ও কৌশল প্রয়োগ করবে। ফলে হয়তো আমরা যারা আল্লাহর রাহের রাহাগীর তাদের জীবনে নেমে আসবে জুলুম নির্যাতন, হামলা-মামলা, জেল-হুলিয়াসহ সব রকম বাধা। এমনকি জীবনের তরে পঙ্গুত্ব কিংবা জীবন কুরবান করে শাহাদাত বরণ করার প্রেক্ষাপট তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে সেই সকল পরিস্থিতির অপর প্রান্তেই বিজয়ের হাতছানী। পবিত্র কুরআনের সূরা ইউসুফের ১০৮, ১০৯ ও ১১০ নং আয়াতে এমনই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
قل هذه سبيلي أدعو إلى الله على بصيرة أنا ومن اتبعني وسبحٰن الله وما أنا من المشركين – وما أرسلنا من قبلك الا رجالا نوحى اليهم من أهل القرى أفلم يسيروا في الأرض فينظروا كيف كان عاقبة الذين من قبلهم ولدار الآخرة خير للذين اتقوا أفلا تعقلون – حتى إذا استبأس رسل وظنوا أنهم قد كذبوا جاءهم نصرنا فنجي من نشاء ولا الرسل و ور بوس – من نشاء ولا يرد بأسنا عـن الـقـوم الـمـجـرمـيـن.
“হে নবী! আপনি বলুন, এটাই আমার পথ- আমি আর আমার অনুসারীগণ আমরা বুঝে-শুনেই আল্লাহর পথে আহ্বান করি। আর আল্লাহ মহা পবিত্র ও আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। আর আপনার পূর্বে জনপদের অধিবাসীদের মধ্য থেকে মহা মানবদেরকে প্রেরণ করেছি যাদের নিকট আমি প্রত্যাদেশ প্রেরণ করতাম। এরা পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে দেখে না কেন? তবে তারা দেখতে পেত তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কেমন ছিল। আর পরকালই তো বেশি উত্তম মুত্তাকীদের জন্য। তোমরা কি বোঝ না? (এভাবেই আল্লাহর পথের আহ্বানকারী নবীগণ আর তাদের বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে লড়াই চলেছে অব্যাহতভাবে) এমনকি (পরিস্থিতির ভয়াবহতায়) নবীগণের মধ্যেও চূড়ান্ত অস্থিরতা এসেছে। তারা আশঙ্কায় পড়ে গেছেন সাহায্যের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত না হওয়ার, এমনই (চূড়ান্ত বিপদের সময়) তাদের নিকট আমার সাহায্য এসেছে। ফলে যাদেরকে ইচ্ছা আমি মুক্তি দিয়েছি, আর অপরাধী সম্প্রদায় থেকে আমার আযাব প্রত্যাহার হয় না। (সূরা ইউসুফ : আয়াত ১০৮, ১০৯, ১১০)
আমরা কোনভাবেই কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার কামনা বা প্রত্যাশা করি না। কিন্তু ইতিহাসের অনিবার্য বাস্তবতায় যে কোন কঠিন পরিস্থিতি আসুক তার মোকাবেলায় আল্লাহর সাহায্যে দৃঢ়পদ ও অটল থাকার ব্যাপারে মানসিকতা তৈরি করতে ও প্রস্তুত থাকতেও যেন ত্রুটি না হয়। আল্লাহর কাছে চাইব আফিয়াত সেই সাথে পরীক্ষার জন্য মানসিক প্রস্তুতি থাকবে। এতে বিপদের সময় ভেঙ্গে না পড়ে ধৈর্য ধরা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। আমার ক্ষুদ্র জেল জীবনের অভিজ্ঞতায় এটাই দেখলাম, যারা মানসিকভাবে কঠিন পরিস্থিতির জন্য কোন রকম প্রস্তুত ছিলেন না তারা সামান্যতেই হতাশ হয়ে পড়েছেন।
আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত পরীক্ষায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে তাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। পক্ষান্তরে যাদের মানসিক প্রস্তুতি ছিল তারা মাশাআল্লাহ হিম্মতের সাথে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছেন।

প্রিয় দ্বীনী ভাই সকল!
আল্লাহর বান্দাদের উপর দুনিয়াতে কঠিন পরিস্থিতি আসে দুই কারণে ।
এক. কোন পাপ বা অপরাধ হওয়ায় গোনাহমাফির জন্য।
দুই. পরীক্ষা বা এবতেলার জন্য।
কারণ দুটির মধ্য থেকে যেটাই হোক মুমিনের কাজ হলো সর্বাবস্থায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার ফায়সালার উপর রাজি থাকা। নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, বিপদে যারা আল্লাহর ফায়সালার উপরে রাজি থাকে তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর যারা বিপদে পড়ে আল্লাহর ফায়সালার উপর অসন্তুষ্ট হয় তাঁদের জন্য রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। এসব কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, দ্বীন বিজয়ের পথে বিপদ আপদের জন্য নিজেদের মানসিকতা তৈরি রাখা। এতে আল্লাহর রহমতে বিপদ অনেকটা আসান হয়ে যায়।
আল্লাহর পথের মুজাহিদ ভাইগণ!
আজ আমাদের সামগ্রিক একটি অধঃপতন ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেটা হলো শাহাদাতের তামান্না আমাদের দিল থেকে দূর হয়ে গেছে। অথচ শাহাদাতের তামান্না ছাড়া ঈমান পূর্ণ হতে পারে না। শাহাদাতের তামান্না না থাকলে বড় বড় কিছু দুর্বলতা দেখা দেয়। যেমন-
এক. ভীরুতা ও কাপুরুষতা।
দুই. দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি মনের আকর্ষণ সৃষ্টি হয়।ফলে দুনিয়াদার মানুষে পরিণত হয়।
তিন. আন্দোলন-সংগ্রামের সময়ে পিছুটান দেয়। ফলে অনেক অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
তাই শাহাদাতের তামান্না দিলে রাখতে হবে। সেজন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করতে হবে।
প্রাণপ্রিয় কাফেলার সহযাত্রী বন্ধুগণ!
দ্বীন বিজয়ের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে আমাদেরকে আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উত্তম সমন্বয় সাধন করতে হবে। তাহলো-
এক. নিজেদের কাজকর্ম, আমল-আখলাক, আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংগঠনের অভ্যন্তরে ‘কঠোর মান অনুশীলনের চর্চা করতে হবে। আমাদের পূর্বসূরী আকাবির-আসলাফের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতি পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করে তাদের যথার্থ উত্তরসূরী হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ইসলামী আন্দোলনের ময়দানে একটি আদর্শ কাফেলা হিসেবে নিজেদেরকে গঠন করতে হবে।
নিজেদের মধ্যে চারিত্রিক, আমলী, আদর্শিক, দৃষ্টিভঙ্গিগত, চিন্তা-চেতনা তথা এক কথায় সীরাত-সুরত হতে হবে অতি উচ্চমানের। এক্ষেত্রে আকাবিরীনে দেওবন্দ-এর পদাঙ্ক অনুসরণকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ বিগত ও বর্তমান শতাব্দীতে আকাবিরীনে দেওবন্দ ইলম, আমল, ত্যাগ ও মুজাহাদা এবং সহীহ ফিকির ও রাহনুমায়ীর ক্ষেত্রে যে নিষ্ঠা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তা এ যুগের সর্বোত্তম নমুনা।
তাই আদর্শিক ও চেতনাগত দিক থেকে আমাদের সংগঠনকে এই ফিকিরের বলিষ্ঠ অনুসারী হতে হবে। বিশেষ করে আকাবিরদের মধ্য থেকে হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.) ও মুজাহিদে আযম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.)-এর সাংগঠনিক আফকার, সেই সাথে আলী মিয়া নদভী (রহ.)-এর সুবিশাল ও বিস্তৃত ময়দানের কর্মপরিকল্পনা এবং হযরত শাইখুল হাদীস (রহ.)-এর হিম্মত ও জযবার সমন্বয় করতে পারলে আমাদের এ উদ্দেশ্য হাসিল হবে।
সেই সাথে ইসলামী আন্দোলন ও জিহাদের ময়দান এবং সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে আরো যে সকল কীর্তিমান পুরুষ যুগে যুগে অবদান রেখেছেন তাদের জীবন চরিতকে উত্তম পাথেয় হিসেবে অনুসরণ করতে হবে।
সারকথা হলো, সংগঠন গড়ে তোলা, জনশক্তির মানোন্নয়ন ও তরবিয়ত এবং সাংগঠনিক পরিবেশের ক্ষেত্রে ইসলামের আযীমত তথা সতর্কতামূলক কঠোর পন্থাকে অনুসরণ করতে হবে। কোন প্রকার বিচ্যুতিকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। এভাবে একটি নুরানী কাফেলা গঠনে নিরলস সাধনা চালাতে হবে।
দুই. ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী রাজনীতি ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হতে হবে। আর এজন্য বৃহত্তর ঐক্য প্রয়াসে ব্যাপক উদার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে। উদার দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকামী সকল পথ ও মতের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনে আমাদের সংগঠনকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু ঈমান-কুফুরের প্রশ্নে অটল থেকে অবশিষ্ট সকল বিষয়ে উদারতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রাজনৈতিক ময়দানে বৃহত্তর ঐক্যের জন্য পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
উপরোক্ত দুটি বিষয়ের দৃষ্টিভঙ্গি একই সঙ্গে লালিত হতে হবে। অন্যথায় সরল-সহজ পথ থেকে বিচ্যুতির সমূহ আশঙ্কা দেখা দিবে। এক দিকে নিজেদের মধ্যকার নীতি ও পলিসি হবে কঠোর ও কট্টর। অপর দিকে অন্যদের সাথে দ্বিপাক্ষিক আচরণের ক্ষেত্রে নীতি ও পলিসি হবে নমনীয় ও উদার।
মনে রাখতে হবে নিজেদের ভিতরকার কট্টরপন্থা ও কঠোরতা অন্যদের উপর আরোপ করতে চাইলে عصبيت উগ্রতা ও অসিহষ্ণুতা জন্ম নিবে। আবার অন্যদের সাথে গৃহীত নমনীয়তা ও উদারতা নিজেদের মধ্যে প্রশ্রয় পেলে
تساهل و تهاون
বিচ্যুতি ও দুর্বলতা দেখা দিবে। এভাবে সংগঠনের অভ্যন্তরে عزيمت আযীমতের দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্যদের সাথে رخصت রুখছতের দৃষ্টিভঙ্গি লালন করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, সংগঠনের অভ্যন্তরেও নিজের ব্যক্তির ক্ষেত্রে এবং সংগঠনের উচ্চ পর্যায়ে আযীমতের নীতি অবলম্বন করতে হবে সেই তুলনায় অন্যের ক্ষেত্রে এবং সাধরণ ক্ষেত্রে রুখছতের পন্থা অবলম্বন করতে হবে।

ইসলামী আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ সাথীগণ!
আমরা একটি মহৎ স্বপ্ন নিয়ে কিছু ভাই যাত্রা শুরু করেছিলাম এ পথে। একটি হতাশাজনক ও তমশাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতে একটু আশার আলো জ্বালবার প্রত্যয় নিয়ে ছিল আমাদের পথ চলার সূচনা। একটু একটু করে চলতে চলতে সময়ের হিসেবে একটি উল্লেখযোগ্য সময় আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। আর আমরা নিজেরা কিছু ভাই দূর সুড়ঙ্গ পথে একটু আলোর ঝলকানী দেখতে পাচ্ছি। তাই আমাদের প্রত্যয় খুব দৃঢ়। আমাদের পদক্ষেপ বেশ জোরালো । আমাদের মনে আছে হিম্মত। বুকে আছে স্বপ্ন। আল্লাহর সাহায্য ও নুসরতের উপর আমাদের আছে অবিচল আস্থা। এই স্বপ্ন, হিম্মত আর তাওয়াক্কুলের সমন্বয়েই আমাদেরকে পথ চলতে হবে ।

প্রিয় দ্বীনী ভাইয়েরা!
দূর থেকে তোমাদের কর্মসূচি, কর্মকাণ্ড ও কর্ম-তৎপরতায় অংশগ্রহণ আর তোমাদের মনে উৎসাহ ও প্রেরণা সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে কথাগুলো লিখলাম। তোমাদের ভাই ও তামাদের দায়িত্বশীল হিসেবে আমার কারাভোগের যন্ত্রণা নিশ্চয় তোমাদের হৃদয়কেও ব্যথিত করেছে। তাই মহান রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন তোমাদেরকেও এই বিপদে সবর করার বিনিময় দান করেন। আমিও তোমাদের দুআ চাই। আল্লাহ যেন আমাকে আগত বিপদের উপর রাজী থাকার ও ধৈর্য ধরার তাওফীক দান করেন। আর আমাদের সকলের ক্ষুদ্র এই কষ্ট ও বিপদকে আল্লাহর দ্বীনের পথে আরো বলিষ্ঠভাবে অগ্রসর হওয়ার উসিলা হিসাবে কবুল করেন। সকল ভাইকে সালাম জানিয়ে শেষ করলাম।
তোমাদের দ্বীনী ভাই
মুহাম্মাদ মামুনুল হক
রুম নং ৪
চন্দ্ৰা, ৫ম তলা
হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার কাশিমপুর, গাজীপুর।
(২০১৩ সালে প্রথম জেলজীবনে লেখা চিঠি)