ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলাম তার অনুসারীদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য দিয়েছে নানা ধরনের ফর্মুলা। আত্মিক উন্নতি সাধন বা আত্মশুদ্ধির জন্য দিয়েছে নানা ধরনের পন্থা। আত্মশুদ্ধি ব্যতিত আর যাই হোক আল্লাহওয়ালা বা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়া যায় না। কুরআনের ভাষায়, ان اكرمكم عند الله اتقاكم অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলার কাছে সবচেয়ে সম্মানিত হলো ওই ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুত্তাকী বা আল্লাহওয়ালা। (সূরা হুজুরাত-১৩)
ইহতিসাব এবং মুহাসাবা আত্মিক উন্নয়ন বা আত্মশুদ্ধিরই একটি অংশ। নিয়মিত ইহতিসাব এবং মুহাসাবা একজন ব্যক্তিকে আত্মিক উন্নয়নের চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে দেয়। বিশেষ করে, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য তো এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; কারণ একজন কর্মী যদি ব্যক্তি জীবনে ইসলামকে বিজয়ী করতে না পারে তাহলে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিভাবে ইসলাম কায়েম করবে? তাই সর্বপ্রথম ব্যক্তিজীবনে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ইহতিসাব এবং মুহাসাবা ।
ইহতিসাব এর অর্থ: মুহাদ্দিসীনে কেরাম এর দুই ধরনের অর্থ বর্ণনা করেছেন,
এক. আল্লাহর কাছে সাওয়াবের আশা করা। যেমন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে (অর্থাৎ আল্লাহর কাছে সাওয়াবের আশায়) রমজান মাসের সিয়াম পালন করে তার সামনের পিছনের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করা হয় (বুখারী, মুসলিম)
দুই: গঠনমূলক সমালোচনা করা বা সংশোধনের উদ্দেশ্যে সমালোচনা করা। এখানে দ্বিতীয় অর্থকে কেন্দ্র করে আলোচনা করা হবে।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ইহতিসাব হল: অপরের কল্যাণ-কামনায় ভুলত্রুটি দেখিয়ে দেয়ার পারস্পরিক সংশোধন পদ্ধতি।
ইহতিসাব এর ভিত্তি
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, المؤمن مرآة المؤمن
এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়না স্বরূপ। যেমনিভাবে আমার চেহারায় কোথায় কি আছে আমি সেটা দেখতে পাই না আয়না আমাকে দেখিয়ে দেয়, এই দেখবার ক্ষেত্রে আয়না তার নিজ থেকে কিছুই বাড়িয়ে বা অতিরঞ্জিত করে দেখায় না, আবার কমও দেখায় না, আর যতক্ষণ আয়নার সামনে থাকা হয় ততক্ষণই সে দোষত্রুটি দেখায়, আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে সে এটা দেখায় না বা বলাবলি করে না। তেমনিভাবে এক মুমিন অপর মুমিনের জন্য আয়না হয়ে কোথায় কোন ভুল ত্রুটি আছে সেটা ধরিয়ে দিবে এক্ষেত্রে নিজ থেকে কোন কিছু বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলবে না বরং যা দেখবে তাই বলবে, সরাসরি তার সামনে বলবে, পিছনে বা অগোচরে কোন কিছু বলবে না।
ইহতিসাবের গুরুত্ব:
* ইহতিসাব গীবতের পথ বন্ধ করে। গীবত হল একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধির নাম। এই রোগের প্রতিষেধকের জন্য গঠনমূলক সমালোচনা চালু থাকা জরুরি। গীবত করা হারাম। গীবত করাকে কুরআনে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। (সূরা হুজুরাত-১২) তাই গীবতের মতো মারাত্মক ব্যাধি থেকে বাঁচতে হলে ইহতিসাব ব্যতিত বিকল্প কোন পথ নেই।
* ইহতিসাব সন্দেহ প্রবণতা, অনুমান ও কুধারণা দূর করে। সন্দেহ প্রবণতা, অনুমান, কুধারণা একটি নিকৃষ্ট ব্যাধি। এ ব্যাধি পারস্পরিক সম্পর্কে ঘুন ধরিয়ে দেয়। কুধারণা সৃষ্টি হওয়ার পর মানুষ গোয়েন্দাগিরির মনোভাব নিয়ে অন্যের দোষ খুঁজতে থাকে। প্রাথমিকভাবে নিজের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয় যে, সবাই খারাপ আর আমিই বোধ হয় ভালো এবং অন্যের ব্যাপারে ভালো কোন ব্যাখ্যা না করে খারাপ ব্যাখ্যা করে থাকে। এই সন্দেহ, অনুমান এবং কুধারণা থেকে বাঁচার উপায় হল গঠনমূলক ইহতিসাব।
এছাড়াও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও গভীর করা এবং ভুল ত্রুটি সংশোধন করে কাজকে সচল এবং গতিশীল করার ক্ষেত্রে ইহতিসাবের অনেক গুরুত্ব রয়েছে।
ইহতিসাবের পদ্ধতি:
১. দোষ খুঁজে বের করবে না বরং প্রকাশ হলে ইহতিসাব করবে।
২.পিছনে বলবে না বরং সামনে বলবে।
৩. ব্যক্তিগত ইহতিসাব একাকী করবে আর বৈঠকের ইহতিসাব বৈঠকে করবে।
৪.বাড়িয়ে বলবে না।
৫. নরম ভাষায় ভাই সম্বোধন করে বলবে।
৬. মন মানসিকতা ও পরিবেশ বুঝে ইহতিসাব করবে।
৭. কারণ বা ব্যাখ্যা দিলে হাসি মুখে গ্রহণ করবে।
যার ইহতিসাব করা হবে তার করণীয়:
১. ধৈর্য সহকারে শ্রবণ করতে হবে।
২. ছলচাতুরির আশ্রয় না নিতে হবে।
৩. সংশোধনের চেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং দোয়া চাইবে।
৪. যথাযথ কারণ বা ব্যাখ্যা থাকলে সুন্দর ভাষায় তুলে ধরবে।
মুহাসাবা বা আত্মসমালোচনা
মুহাসাবা শব্দের অর্থ: গণনা করা, হিসাব করা। আত্মসমালোচনাকে আরবিতে মুহাসাবাতুন নফস বলা হয়। সাধারণত নিজের গুনাহ-অপরাধ এবং দোষ ত্রুটি হিসাব করাকে মুহাসাবা বলে।
ইমাম মাওয়ারদী রহ. বলেছেন, ব্যক্তি রাতের কোন সময়ে তার দিনের কাজগুলো যাচাই বাছাই করে দেখবে। যদি সেগুলো ভালো ও প্রশংসনীয় হয় তাহলে তা যথারীতি বহাল রাখবে এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ কাজ সামনে এলে তা করে যাবে। আর যদি তার কাজগুলো নিন্দনীয় হয় তাহলে যথাসম্ভব তার প্রতিকার করবে ভবিষ্যতে ঐ জাতীয় কাজ থেকে বিরত থাকবে। সুতরাং মুহাসাবা হল, নিজের কথা ও কাজের ভালো মন্দ হিসাব ও যাচাই করে মন্দ যা মিলবে তা সংশোধন করা এবং সৎ ও ভালো যা পাবে তা করে যাওয়া।
মুহাসাবার মূলভিত্তি:
* আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে বান্দাদেরকে নিজের হিসাব নিজে গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
ايها الذين امنوا ولتنظرنفس ما قدمت لغد واتقوا الله ان الله خبيرتعملون بما يا
* হযরত উমর রা. বলতেন, তোমার হিসাব নেওয়ার আগেই তুমি নিজেই নিজের হিসাব করো এবং সেই মহাসমাবেশে হাজির হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। যে ব্যক্তি দুনিয়াতে নিজের হিসাব নিজে নিবে অর্থাৎ মুহাসাবাতুন নফস করবে কিয়ামতের দিন তার হিসাব অত্যন্ত হালকা এবং সহজ হবে (তিরমিজী)
তাছাড়া, একজন মুমিন ব্যক্তির এটি একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে, সে সর্বদা নিজের কৃতকর্মের ব্যাপারে সজাগ থাকবে। আর ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য তো এটা আবশ্যিক বিষয়। মানুষ হিসেবে ত্রুটি বিচ্যুতি হতেই পারে; কিন্তু মুমিন ব্যক্তি নিজের কাজকর্ম নিজে মূল্যায়ন করবে, এবং ত্রুটি হয়ে গেলে সেটা সংশোধন করে নিবে। পক্ষান্তরে কাফের বেঈমানরা থাকে নিজেদের কৃতকর্মের ব্যাপারে গাফিল বা উদাসীন।
মুহাসাবার বিষয়: মুহাসাবা বা আত্মসমালোচনার দুটি দিক।
এক. যে কাজ করা হয়নি।
দুই. যে কাজ করা হয়ে গেছে।
* যে কাজ করা হয়নি এক্ষেত্রে আত্মসমালোচনা হল, কাজটা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ কিনা সর্বপ্রথম এটা দেখতে হবে; অতঃপর দেখতে হবে কাজটা কি নিয়তে করা হচ্ছে, লোক দেখানোর জন্য নাকি দুনিয়ার কোন স্বার্থে, এই উভয়টার কোন একটার জন্য হলে নিয়ত সংশোধন করে নিতে হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কাজটা করতে হবে।
* যে কাজ করা হয়ে গেছে এক্ষেত্রে আত্মসমালোচনার বিষয় হলো, অতীত আশ্রয় জীবন স্থবির। মানসিক বেদনা ও রোগের উৎস। অতীতে অনেক ভুল হয়েছে তো সেগুলো নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না
ভুলগুলো চিহ্নিত করতে হবে। গুনাহ গুলোর জন্য আন্তরিকভাবে তাওবা করতে হবে। সেগুলো যেন পুনরায় সংগঠিত না হয় সে ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। তার ভালো কাজগুলোর উপর অবিচল থাকতে হবে।
মুহাসাবাতুন নফসের সময়:
এক. রাতে ঘুমানোর পূর্ব মুহূর্তে।এই সময়টাই অধিক উত্তম। ঘুমানোর আগে ইস্তিন্ঞ্জা,ওযু করে সম্ভব হলে জায়নামাজ বিছিয়ে কিবলামুখী হয়ে বসে মুহাসাবাতুন নফস করবে।
দুই: ঘুমানোর আগ মুহূর্তে নিয়মিত করা কঠিন মনে হলে এশার ফরজ, সুন্নাত, বিতরের নামাজের পর নামাজের স্থানে বসে নিয়মিত মুহাসাবাতুন নফস করবে।
মুহাসাবাতুন নফসের পদ্ধতি:
এক. অজুর সাথে পবিত্র স্থানে কেবলামুখী হয়ে বসবে।
দুই: চোখ বন্ধ করে আল্লাহ তাআলাকে হাজির-নাজির জানবে।
তিন: সারাদিনের কর্মব্যস্ততা স্মরণ করবে, করণীয় আমলগুলো স্মরণ করবে, কৃত পাপগুলো স্মরণ করবে, সাংগঠনিক দায়িত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে।
চার: অতঃপর ভালো কাজের জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করবে আর যে সকল ত্রুটি বা মন্দ কাজ হয়েছে কিংবা দায়িত্ব পালনে গাফলতি হয়েছে সেজন্য তাওবা করবে।
তাওবার নিয়ম:
ক. নিজ কৃতকর্মের উপর লজ্জিত হতে হবে।
খ. সেজন্য কায়মনাবাক্যে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
গ. ভবিষ্যতে এ ধরনের ত্রুটি না করার প্রতি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে নিয়মিত মুহাসাবাতুন নফস করলে আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে বলা যায়, জীবনের ত্রুটি বিচ্যুতি কমতে থাকবে এবং ব্যক্তি একটি জবাবদিহিতামূলক ও দায়িত্বশীল জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। যার ফলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে ন্যায় এবং ইনসাফের সুশীতল হাওয়া বইতে থাকবে।
না থাকার কুফল:
বর্তমানে আমাদের মধ্যে ইহতিসাব এবং মুহাসাবার চর্চা একদম নেই বললেই চলে। যা আছে সেটাও একদম কম বা নিভু নিভু প্রদীপ। আর এ কারণেই সমাজ এবং রাষ্ট্রের মধ্যে অন্যায়-অপকর্মের সয়লাব, অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি, মারামারি- হানাহানি, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রত্যেকটা সেক্টরে দুর্নীতি, একে অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব বেড়েই চলছে। আর এ সবই হচ্ছে জবাবদিহিতার চর্চা না থাকা, ইহতিসাব এবং মুহাসাবার প্রতি গুরুত্ব না দেওয়া। সুতরাং ন্যায়- ইনসাফভিত্তিক দুর্নীতিমুক্ত সুষ্ঠু সুন্দর সমাজ গড়তে হলে ইহতিসাব এবং মুহাসাবার চর্চা ব্যাপক করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন । আমীন!