ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের কাঙ্ক্ষিত মান ও বৈশিষ্ট্য: মাওলানা হাশমতুল্লাহ ফরিদী

বিজয় ও স্বাধীনতার পূর্ব শর্ত একটি সফল আন্দোলন। আর একটি সফল আন্দোলনের পূর্ব শর্ত একটি মজবুত সংগঠন গড়ে তোলা। আর একটি মজবুত সংগঠন গড়ে তুলতে পারলে তখনই সম্ভব একটি সফল সুন্দর আন্দোলনের স্বপ্ন দেখা। পৃথিবীর ইতিহাস ইতিহাস একথার প্রমাণ যে, পৃথিবীর দিগদিগন্তে যত স্বাধীনতা বসন্তের বিজয় ধ্বনি কিংবা জয়োগান গেয়েছে সবগুলোর পিছনে ছিল একটি শক্তিমান কর্মমুখর সংগঠন। বিক্ষিপ্ত বিশৃঙ্খল জনগোষ্ঠী দ্বারা পৃথিবীর ইতিহাসে কোন বিপ্লব সংগঠিত হয়নি। তবে সময়ের প্রয়োজনে আবেগের জোয়ারে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন ফায়দামুক্ত নয়। কিন্তু তাতে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় না। এ জন্য প্রয়োজন একটি সঠিক সংগঠন। মজবুত সংগঠন। আর ভালো মানের সঠিক সংগঠন নির্ভর করে তার কর্মীবাহিনীর ওপর। কর্মীরা যদি কাক্সিক্ষত মানের হয় এবং সংগঠনকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস ভক্তি ও সংগঠনের নির্ধারিত নীতিরীতি জীবনে বাস্তবয়ান করে তাহলেই সম্ভব একটি মজবুত সুন্দর জোরালো সংগঠন গড়ে তোলা। ।
আমাদের এ সংগঠন গতানুগতিক কোন সংগঠন নয়। শুধু কয়েকটি কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আমরা এ সংগঠন গড়ে তুলিনি। আমাদের প্রথম ভিত্তি জনশক্তি গঠন। একটি বাস্তবমুখি ইসলামী আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার জন্য যে মানের জনশক্তি প্রয়োজন সেই মানের জনশক্তি গড়ে তোলা আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীর যে মান ও বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার তা জানা ও তা অর্জনে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হওয়া এ সংগঠনের কর্মীদের জন্য জরুরি। কোন কর্মী যদি সঠিকভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে সফল হয় তাহলে তার জন্য এ সংগঠন করা স্বার্থক হবে। আর যদি নিজে কাক্সিক্ষত মান অর্জনের জন্য আন্তরিক না হয় তাহলে তার জন্য এ সংগঠন করা স্বার্থক হবে না। বরং অনর্থ সময় শ্রম মেধা অর্থ খরচ হবে।
আমাদের এ সংগঠনের একটা চিন্তা ও দর্শন আছে। কর্মীদের সর্বপ্রথম এ চিন্তা ও দর্শন বুঝতে হবে, নিজের মধ্যে লালন করতে হবে। নিজের মগজ মনে আত্মস্থ করতে হবে। অতপর বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই চিন্তা ও দর্শন বুঝতে ব্যর্থ হলে, লালন করতে অক্ষম হলে সংগঠন বাস্তবায়ন হবে না। কর্মীর মান ও বৈশিষ্ট্য আমাদের মূল চিন্তার সাথে সম্পৃক্ত। কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারা, কিছু ছোটা-ছোটি করতে পারা, নেতৃত্ব দিতে পারা এগুলো আমাদের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীর জন্য যথেষ্ট নয়।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হতে হলে ইসলাম সংগঠন জীবনবোধ ও সাংগঠনিক মেজাজ গড়তে হবে। ইসলামী আন্দোলনের পরিচয় ও কর্মীর পরিচয় একত্রিত করলে সর্বসাকুল্যে আমাদের সামনে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি পরিচয় ফুটে ওঠে। এ পাঁচ পরিচয় বিশ্লেষণ করলে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীর মানও সামনে চলে আসবে।
১. ইসলামী আন্দোলনের কর্মী একজন খাঁটি মুমিন।
২. ইসলামী আন্দোলনের কর্মী একজন দায়ী ইলাল্লাহ।
৩. ইসলামী আন্দোলনের কর্মী একজন সমাজকর্মী।
৪. ইসলামী আন্দোলনের কর্মী একজন সংগঠক।
৫. ইসলামী আন্দোলনের কর্মী একজন মুজাহিদ ফী সবিলিল্লাহ।
এ পঞ্চপরিচয়ের সমষ্টি হচ্ছে একজন ইসলামী আন্দোলনের কর্মী।
খাঁটি মুমিন
ইসলামী আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য আল্লাহর দ্বীন বিজয় করা। আল্লাহর দ্বীন বিজয় করা তো তার দ্বারা সম্ভব যে আল্লাহর দ্বীনের যথাযথ খাঁটি অনুসারী। আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে যার সংশয় আছে, দ্বীন পালনে যার দুর্বলতা আছে সে তো ইসলামী আন্দোলনের ভাল কর্মী হতে পারবে না। যে আদর্শে যার আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি আছে, পালনে অনীহা আছে তার দ্বারা তো সম্ভব নয় ঐ আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ দেওয়া। চূড়ান্ত লড়াইয়ে অংশ নেওয়া। যার আস্থা ভালবাসা ঈমান আনুগত্য ইসলামের প্রতি শতভাগ আছে ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে সর্বোচ্চ ত্যাগ কুরবানী করা। চূড়ান্ত লড়াইয়ে অংশ নেওয়া তার জন্য অতি মামুলি ব্যাপার। এমনটাই খাঁটি মুমিনের পরিচয়।
দায়ী ইলাল্লাহ
ইসলামী আন্দোলনের শিক্ষা ও মানার সঠিক উপলব্ধি বুকের ভিতর এ আলোকবিভা লুকিয়ে রাখার সুযোগ দেয় না যে, সে নিজে আলোকিত হবে বরং ব্যক্তি অন্তর্জ্বালায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে দুনিয়ার সকল মানুষের কাছে এ আলো পৌঁছে দিতে। এর একটি উদাহরণ দিই, হযরত আবূ যর গিফারী রা. কে না চেনে ঘটনা তার। তিনি হিজরতের পূর্বে যখন মক্কায় পৌঁছেন তখন মক্কার পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে মক্কার পামরা তার উপর অকথ্য নির্যাতন চালাতো। কেউ যেন নবীয়ে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে মিশতে না পারে এ ব্যাপারে কঠোর পাহাড়াদারিও তারা চালাতো। তিনি পৌঁছা মাত্র মক্কাবাসীদের পক্ষ থেকে সতর্ক করে দেওয়া হল, ‘এখানে এক পাগল আছে। সে মানুষকে ধর্ম ত্যাগী বানায়। মানুষের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করে। তার থেকে সাবধান থাকবে’। আবু যরের কৌতুহলি মন আনচান হয়ে ওঠে এমন পাগলকে দেখার জন্য। পরের ঘটনা আরো মজাদার, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চারিত্রিক মাধুর্যতায় ও ইসলামের অকৃত্রিম রূপ জৌলুশে মুগ্ধ হয়ে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম তাকে বললেন, তোমার ইসলাম গ্রহণের সংবাদ মক্কায় প্রকাশ করার দরকার নেই। তুমি বাড়িতে যেয়ে নিজ সাধ্য মত আমল করতে থাক। পরবর্তীতে যখন আমাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে তখন তোমাকে সংবাদ দিব। তুমি আমাদের সাথে মিলিত হবে।
কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম এর পবিত্র দরবার থেকে বের হয়ে তাঁর ভিতরে আলোকবিভা জ্বলে উঠলো, আমি যে মহাসত্যের সংবাদ পেয়েছি তা মক্কাবাসীকে না জানিয়ে মক্কা থেকে চলে যাব? তা হতে পারে না। তিনি কাবা চত্বরে গেলেন। উপস্থিত জনতাকে সমবেত করে নিজের ঈমানের জানান দেওয়ার জন্য বলা শুরু করলেন, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। বাস, এতোটুকু পর্যন্ত গেলেন। শেষ করতে পারলেন না। চতুর্দিক থেকে শুরু হয়ে গেল পৈশাচিক নির্যাতন। তীব্র আক্রমণে বেহুঁশ হয়ে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। আব্বাস ইবনে আবী তালেবের মত কয়েক জন ভারসাম্য পূর্ণ বিচক্ষণ ব্যক্তি মিলে ওদের কবল থেকে তাকে উদ্ধার করে। তাকে বুঝিয়ে বলে, এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেছ। ভাল চাইলে তাড়াতাড়ি মক্কা ছাড়ো। তিনি কাবা চত্বর থেকে বের হলেন। কিন্তু মক্কাবাসীদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার প্রেরণায় দ্বিতীয় দিন আবার এলেন। এবার তাড়াতাড়ি পড়লেন। যেন, তাদের কাছে পূর্ণ কালিমার দাওয়াত পেশ করতে পারেন। কালিমায়ে শাহাদাত শেষ হওয়া মাত্র শুরু হলো আক্রমণ। আক্রমণের মাত্রা হল গতকালকের চেয়ে অনেক তীব্র।
এখানে রহস্য হল, ইসলামের দাওয়াত একটি বিপ্লবী দাওয়াত। এ দাওয়াত যে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে তা তাকে স্থির থাকতে দেয় না। সর্বপ্রথম তার নিজের ভিতর বিপ্লব সাধন করে। অতপর তাকে উদগ্রীব করে তোলে বিশ্ববাসীর কাছে এ দাওয়াত পৌঁছে দিতে। তার ভিতরে প্রেরণার তুফান উঠে। আবূ যর গিফারীর মতো এ প্রেরণা যার ভিতরে সৃষ্টি হবে না, বুঝতে হবে সে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনকে সঠিক অর্থে উপলব্ধি করতে পারে নাই। এটা নিজেকে যাচাই করার একটা প্রমাণ। মানুষের কাছে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার অনুপ্রেরণা যদি আমি নিজের ভিতর থেকে পাই, সকল মানুষকে এ আন্দোলনের সঙ্গী বানানোর স্বপ্রণোদিত অনুভূতি পাই তাহলে বুঝা যাবে আমি ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি।
সমাজকর্মী
ইসলামী আন্দোলন একটি সামাজিক কাজ। আর মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের সবচেয়ে ক্ষুদ্র পরিসর পরিবার। সমাজ বলা হয় একটা নিয়মের আওতায় বিক্ষিপ্ত কিছু মানুষের বসবাস। ইসলামী আন্দোলনে একজন কর্মী একজন সমাজকর্মী। সে নিজেকে সমাজ থেকে পৃথক রাখে না। সে যে সমাজে বাস করে নিজেকে সেই সমাজের অন্যান্য মানুষের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে রাখে। অন্য জনের প্রয়োজন পূরণ করা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীর অন্যতম পরিচয়। সে নিজেকে রাজনৈতিক কর্মী মনে না করে, সমাজের একনিষ্ঠ খাদেম মনে করবে। সমাজের উপকারে ও দেশ জাতির সমৃদ্ধির তরে সে সমাজের প্রতি সেক্টরে নিজ সমাজের স্বার্থে স্বার্থবিহীন শ্রম দেয়। সমাজের অপরাপর মানুষের জন্য সে নিজের জীবন বিলাতে প্রস্তুত থাকে। অন্যের প্রয়োজনে আয়োজনে থামে অগ্রসরমান।
সংগঠক
সংগঠক দ্বারা উদ্দেশ্য এমন ব্যক্তি যে বিক্ষিপ্ত তরুণ প্রজন্মকে অশৃঙ্খলিত ছাত্রজনতাকে ইসলামের জন্য সংগঠিত করবে। মানুষের জন্য কাজ করা সহজ। কিন্তু একজন যতই দক্ষ, অভিজ্ঞ হোক সে কতই আর কাজ করতে পারবে? তা না করে যে ব্যক্তি বিশজন মানুষকে একতাবদ্ধ করে তাদের সম্মিলিত শক্তিকে এক ধারায় প্রবাহিত করে তার কাজের পরিমাণ পরিধি বিস্তৃত অনেক বেশি হবে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীকে সংগঠনের গুণ আত্মস্থ করতে হবে। যে কর্মী দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে সব কিছু একা সমাধান করে যাচ্ছে সে ইসলামী আন্দোলনের আদর্শকর্মী নয়। বরং যে নিজেও করছে আরো মানুষকে সম্পৃক্ত করে কাজ ভাগ করে সকলকে নিয়ে কাজ করছে সে আদর্শকর্মী।
মুজাহিদ ফী সাবীলিল্লাহ
এক জন মুজাহিদ ফী সাবীলিল্লাহর গুণ হলো, মহান আল্লাহর দ্বীনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ ও কুরবানী করতে সে সদাসর্বদা প্রস্তুত। নিজের জান, মাল সব কিছু হাসি মুখে মহান আল্লাহর দ্বীনের জন্য দিয়ে দিতে সে ইতস্তত করে না। ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী সেও একজন মুজাহিদ ফী সাবীলিল্লাহ। সেও দ্বীনের স্বার্থে নিজের জীবন সম্পদ চাওয়া পাওয়া সব কিছু বিসর্জন দিতে তৈরি থাকে। জান দেওয়ার অর্থ শুধু চূড়ান্ত পর্যায়ে আত্মবিসর্জন দেওয়া নয়। জীবন সময়ের নাম। জীবনকে মহান আল্লাহর জন্য দেওয়ার অর্থ হচ্ছে সময় আল্লাহর দ্বীনের জন্য দেওয়া। যার সংগঠনিক ক্লাস বৈঠক তরবিয়াতি সফর মজলিস দাওয়াতি মিছিল কর্মশালায় আসার সময় নেই দাওয়াতের কাজ করার সময় নেই নিজেকে গঠন করার সময় নেই ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করার সময় নেই তার সময় আছে ঘোরাফেরা করার, আর যাই হোক তার সংগঠন হবে না। সেও আদর্শ কর্মী হতে পারে না। তার দ্বারা শুধু অনর্থ ঘোরাফেরা খেলাধুলা ফেইসবুকিং টেটিং চ্যাটিং হবে। এই পাঁচগুণ যাদের মাঝে আছে তারা ইসলামী আন্দোলনের জিন্দাদিল কর্মী।
উক্ত পরিচয়গুলো অর্জনের উপায়
আমাদেরকে আত্ম গঠনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ কুরবানীর জন্য ও সর্বোপরি আদর্শ সংগঠক হতে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। উক্ত পরিচয়গুলো কিছু কাজ দাবি করে। এ কাজগুলো করতে পারলেই তার ভিতরে পরিচয়গুলো বাস্তবতার সুখফল মিলবে। কাজের আলোকে উক্ত পাঁচটি পরিচয়কে বিশ্লেষণ করলে আমরা দু’ ধরণের পরিচয় পাই। কিছু কাজ এমন যা সকল পরিচয়কেই দাবি করে। যে কাজগুলো না করলে উক্ত পাঁচ পরিচয়ের কোনটাই অর্জন হবে না। আবার কিছু কাজ এমন যা নির্দিষ্ট পরিচয়কে দাবি করে।
অপরিহার্য সাধারণ কাজ চারটি। যথা:
১. আততাআল্লুক মাআল্লাহ (আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক) সম্পর্ক দু’ ধরণের। যথা: ক. সরাসরি সম্পর্ক। খ. মাধ্যম সম্পর্ক। পাশ্চাত্যের সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পৃথিবীতে তিনটা সম্পর্ক সরাসরি। যথা: ক. জন্মদান সম্পর্ক খ. জন্মগ্রহণ সম্পর্ক ও গ. বিবাহ বন্ধনের সম্পর্ক উক্ত তিন ধরণের সম্পর্ক ছাড়া যত ধরণের সম্পর্ক আছে সব সম্পর্ক অন্যের মাধ্যমে স্থাপিত হয়। ইসলামী সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সরাসরি সম্পর্ক মাত্র একটি। যথা: স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক। এ ছাড়া যত সম্পর্ক আছে সব সম্পর্ক অপরের মাধ্যমে। পিতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক আল্লাহর মাধ্যমে। আল্লাহ সন্তানকে এ পিতার ঔরসে জন্ম দিয়েছেন বিধায় সে তার পিতা। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সাথে তার সম্পর্ক হচ্ছে তাদেরকে ওই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন যিনি তাকেও সৃষ্টি করছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে তার সরাসরি সম্পর্ককে বিশ্বাস করবে বা মূল্যায়ন করবে; সে এ সম্পর্কের স্বার্থে পৃথিবীর সকলের সাথে সঠিক আচরণ করবে। মানুষকে দ্বীনের দিকে দাওয়াত দিবে। কেননা তারাও আল্লাহর বান্দা। সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষের খেদমত করবে। কেননা সমাজ ও রাষ্ট্র আল্লাহর বান্দার। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: সকল সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারের সদস্য। যে আল্লাহর পরিবারের প্রতি সদয় হবে সে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়পাত্র। আল্লাহর হুকুম থাকার কারণে সে ক্ষুধার্তকে অন্ন দিবে। আল্লাহর হুকুম থাকার কারণে অসুস্থকে সেবা দিবে। আবার আল্লাহর হুকুম থাকার কারণে মানুষকে আঘাত করবে। গুলি করবে। দেশকে ভালোবাসবে। কেননা আল্লাহ তাকে এ দেশে পাঠিয়েছেন। দেশের ভালোবাসার দাবি পূরণ করতে যদি জীবন দিতে হয় দিবে। আবার দেশের ভালোবাসা পূরণ করতে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয় তাহলে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখা হবে। দেশের সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলা হবে। রাজনীতি করা হবে, কেননা আল্লাহ আমাকেও সৃষ্টি করেছেন এ রাষ্ট্রকেও সৃষ্টি করেছেন, জনগণকেও সৃষ্টি করেছেন। রাজনীতির দ্বারা এ দেশে আল্লাহর নীতি বাস্তবায়ন করা হবে। এ দর্শন একজন মুসলিমের দর্শন। যখন এ দর্শনকে সঠিক ভাবে লালন করতে পারবে তখন সে একজন ভাল মুসলিমও হতে পারবে।
২. ইলম ওয়াল ইসতি’দাদ (জ্ঞান ও যোগ্যতা) ইলম ছাড়া ঈমান পূর্ণ হয় না। আমল সঠিক হয় না। জ্ঞান ও যোগ্যতা না থাকলে সমাজের খেদমত করা যায় না। অযোগ্য মানুষের হাজারো ইচ্ছা থাকলেও সমাজ সেবা ভালোভাবে করতে পারবে না। উপরন্তু আরো ক্ষতি করবে। জ্ঞনের ঘাটতি থাকলে দাওয়াতের কাজ ভালোভাবে করা যায় না। দক্ষতার অভাব থাকলে মানুষকে সংগঠিত করা যায় না। জিহাদ ভালোভাবে করতেও প্রয়োজন জ্ঞানের। সুতরাং জ্ঞান অজর্নের পাশাপাশি যোগ্যতা একজন কর্মীর জন্য অবশ্যকীয় করণীয়।
৩. আল আখলাকুল হাসানাহ (উত্তম মানবীয় চরিত্র) যার চরিত্র ভাল না সে ভালো ঈমানদার না। যার চরিত্র ভালো না সে দাওয়াতের কাজ করতেই পারবে না। চরিত্রহীন মানুষের দাওয়াতে মানুষ সাড়া দেয় না। কথার চেয়ে আচরণে বেশি মানুষ দাওয়াত গ্রহণ করে। চরিত্রবান মানুষের কথা অপরকে প্রভাবিত করে। যদি আপনার মুখের ভাষা কর্কষ হতো, আপনি কঠিন মনের হতেন তাহলে আপনার পাশে কেউ থাকতো না। আপনি তাদের প্রতি ক্ষমাশীল হোন। (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯) তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। কাজের ব্যাপারে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতএব, মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে হলে ব্যবহার সুন্দর হতে হবে। খারাপ ব্যবহার করে মানুষকে সংঘবদ্ধ করা যাবে না। দু’ মুঠো অন্ন দিয়ে লাথি মারলে মানুষ বলবে তোমার অন্নের দরকার নেই। জিহাদের ময়দানেও শত্রু পক্ষের সাথে মার্জিত, নিয়ন্ত্রিত সদ্ব্যবহার ইসলামী যুদ্ধনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
৪. আল হিকমাতুল আমালিয়্যাহ (উত্তম কর্মকৌশল) আল্লাহ তাআলা মানুষকে যে হিকমাত দান করেছেন তা অর্জন করতে হবে। যে তা অর্জন করতে পারবে সে ঈমানের লাইনে তাড়াতাড়ি অগ্রসর হতে পারবে। তার দাওয়াত অধিক ফলপ্রসু হবে। যার কর্ম কৌশলে যত সুন্দর্য ও নিপুণতা থাকবে সে সমাজের ততোবেশি সেবা করতে পারবে। ততোবেশি মানুষকে সংগঠিত করতে পারবে। জিহাদের ময়দানেও ততোবেশি নৈপুণ্য দেখাতে পারবে। হাদীসে আছে- মুমিনের দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষè। সে বুঝে-শোনে সাজিয়ে-গোছিয়ে কাজ করে।
পাঁচ পরিচয়ের জন্য বর্ণিত চার বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে হবে। এগুলো অর্জনের জন্য বিরামহীন সাধনা দরকার। তাই ইসলামী আন্দোলনের কাজ আজীবন সাধনার কাজ। এটা অবসর সময়ের কাজ না, কিছু দিনের কাজ না। যদি ইসলামী আন্দোলনের কাজ কেউ বুঝে থাকে তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য আর কিছুই করতে হবে না। পড়া-লেখাটাও ইসলামী আন্দোলনের কাজ। এ ধরণের অনেক কাজ আমরা এখন করে থাকি যা কিন্তু মূলত: ইসলামী আন্দোলনের কাজ কিন্তু সেগুলো সব বিক্ষিপ্ত, ছড়ানো-ছিটানো। এ সকল বিক্ষিপ্ত কাজগুলোকে একটা স্রোতে প্রবাহিত করাটাই হল একটি সংগঠনের কাজ। একটি প্রাকৃতিক উদাহরণ দিই- পাথরের পাহাড়ি এলাকাতে দেখা যায় ঘণ্টা খানেক বৃষ্টি হলে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে সাত থেকে পনের দিন পর্যন্ত স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে। অথচ আমাদের দেশে সাত ঘণ্টা বৃষ্টি হলেও সাত দিনের স্রোত হয় না। এলাকা প্লাবিত হয় না। পার্থক্য হল আমাদের সমতলে যখন বৃষ্টি হয় তখন বৃষ্টির বড় অংশ পতনের মাটি চুষে নেয়। এ পানি সকল একত্রিত হওয়ার সুযোগ পায় না। কিন্তু পাথরের পাহাড়ি এলাকাতে বৃষ্টি হলে মাটি পানি চুষে নেয় না। উপরন্তু পাহাড়ের গা বেয়ে সব পানি নিচে নেমে এসে এক স্রোতে প্রবাহিত হয়। তাই এক ঘণ্টার বৃষ্টির পানি পনের দিন পরেও বয়ে যেতে থাকে। ইসলামী সংগঠনের কাজটাই হচ্ছে ইসলাম প্রিয় জনতার বিক্ষিপ্ত ছড়ানো ছিটানো প্রচুর কাজকে এক স্রোতে, এক গতিতে প্রবাহিত করা। তখন এ স্রোতের গতিতে সমাজ পরিবর্তিত হবে। ইসলামী আন্দোলনের কাজ জীবনব্যাপী কাজ। প্রথমত নিজেকে গঠন করতে হবে, গড়তে হবে। অতপর নিজেকে সমাজের কাজে, দ্বীনের কাজে মাশগুল রাখতে হবে। এ ভাবেই জীবন চলতে থাকবে।
বর্ণিত চারটি বৈশিষ্ট্য অর্জন হওয়ার কতোগুলো আমল আছে যা করতে থাকলে অটোমেটিক বাকিগুলো হয়ে যাবে। যেমন, তাআল্লুক মাআল্লাহ অর্জনের জন্য চারটি কাজে গুরুত্ব দেওয়া। যথা:-
১. ফরজের কঠোর পাবন্দি করা। ২. সুন্নতের প্রতি অধিক যত্নবান থাকা। ৩. নিয়মিত নফলের অভ্যাস করা। যেমন নফল নামায, সদকা রোজা ইত্যাদি। ৪. যিকর করা।
একজনকর্মীর মাঝে উল্লিখিত গুণের সমাবেশ হলে একটি সফল সুন্দর সার্থক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব। আর ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য কাক্সিক্ষত মান ও বৈশিষ্ট্য তখন-ই সুন্দরভাবে পরিস্ফূটিত হবে। আল্লাহ পাক আমাদেরকে উল্লিখিত গুণের দ্বারা গুণান্বিত হওয়ার তৌফিক দান করুক। আমিন।

শেয়ার করুন

আরো পড়ুন

যোগদিন আমাদের সাথে

ইসলামের মূল তিন কাজ- তা’লীমে দ্বীন (দ্বীনের শিক্ষা), তাবলীগে দ্বীন (দ্বীনের দাওয়াত) ও তাগলীবে দ্বীন (দ্বীনের বিজয়) এর সমন্বয়ে ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য পাঁচ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ১. দাওয়াত, ২. সংগঠন, ৩. প্রশিক্ষণ, ৪. সমাজকল্যাণ, ৫. আন্দোলন। আমি বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস ঘোষিত কর্মসূচির সাথে একাত্মতা পোষণ করছি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এ সংগঠনে যোগদান করছি।

Scroll to Top